শেয়ারবাজারের ষাঁড় ও ভালুকের গল্প

শেয়ারবাজার চাঙা। বিনিয়োগকারীদেরও ভিড় বাড়ছে বাজারে। তাত্ত্বিকভাবেই বাজারটা ঝুঁকির। তাই বিনিয়োগ করতে হয় জেনেশুনে। অবশ্যই জানা উচিত এমন কিছু বিষয় নিয়েই এবারের মূল আয়োজন।

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের কথা ভাবছেন? ভালো কথা। নিশ্চয় আপনি জানেন, শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ অন্য যেকোনো বিনিয়োগের চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। আপনি হয়তো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। তাহলে তো কথাই নেই। আপনার অর্থ আপনি কোথায় কীভাবে ব্যবহার করবেন, সেটা একান্তই আপনার সিদ্ধান্ত। তবে আপনার কষ্টের টাকা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে খাটানোর আগে জানা দরকার শেয়ারবাজারের টুকিটাকি কিছু বিষয়, যা আপনার বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে ও শেয়ারবাজার বুঝতে কিছুটা হলেও সহায়তা করবে।

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের কথা ভাবছেন, শেয়ার কী এবং কীভাবে শেয়ারের লেনদেন হয়, জানেন তো? আবার শেয়ারবাজারই কী ধরনের বাজার, সে সম্পর্কে ধারণা আছে তো? আসুন, প্রথমেই জেনে নিই,

শেয়ার কী

শেয়ার হচ্ছে কোনো কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার মালিকানার একটি অংশ। যেকোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানেরই মালিকানা থাকে। যেমন থাকে সম্পদের মালিকানা। কোম্পানির মালিকানা নানা ধরনের হতে পারে। সেই মালিকানার অংশ নির্ধারণ বা সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি হচ্ছে শেয়ার। ধরা যাক, ‘এ’ একটি কোম্পানি। সেটির মালিকানার অংশীদার ১০ জন। আর কোম্পানিটির মূলধন ১ লাখ টাকা। তার মানে ১০ জন মালিকের প্রত্যেকে কোম্পানিটিতে ১০ হাজার টাকা করে মূলধন বিনিয়োগ করেছেন। এখন কোম্পানিটি বা তার ১০ মালিক চাইলে তাঁদের মালিকানার অংশটিকে শেয়ারে রূপান্তর করে নিতে পারেন। তবে কোম্পানিটির কতগুলো শেয়ারে এই ১০ জনের মধ্যে বণ্টন করা হবে, তা নির্ভর করবে ওই শেয়ারের অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালু কত হবে তার ওপর। অভিহিত মূল্য ১০০ টাকা হলে সে ক্ষেত্রে প্রত্যেক মালিক ১০০টি করে শেয়ার পাবেন। এ ধরনের শেয়ারেরই লেনদেন হয় শেয়ারবাজারে।

মার্কেট কখন বুল, কখন বেয়ার

শেয়ার কী জানলেন। কোথায় এ শেয়ারের হাতবদল হয়, তা–ও জানলেন। এখন তবে জেনে নিন শেয়ারবাজারের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে দুটি শব্দ খুব বেশি ব্যবহৃত হয়। তার একটি বুল মার্কেট, অন্যটি বেয়ার মার্কেট। বুল মানে ষাঁড়, আর বেয়ার মানে ভালুক—এটা সবারই জানা। তাই কেউ কেউ মজা করে ষাঁড়ের বাজার বা ভালুকের বাজারও বলে থাকেন। শেয়ারবাজারে যখন তেজিভাব বা চাঙা থাকে, তখন সেই বাজারকে বুল মার্কেট বলা হয়। আর যখন বাজারে মন্দাভাব থাকে, তখন সেটিকে বেয়ার মার্কেট হিসেবে অভিহিত করা হয়। তেজি বাজারকে ষাঁড়ের সঙ্গে এবং মন্দা বাজারকে ভালুকের সঙ্গে তুলনা নিয়েও আছে নানা রকম মুখরোচক গল্প। যদিও এসব গল্পের সত্যতা নিয়ে রয়েছে সংশয়। সবচেয়ে বেশি প্রচলিত গল্পটি হচ্ছে ষাঁড় যখন ক্ষিপ্ত হয়, তখন ওপরের দিকে লাফ দেয়। এ কারণেই অনেকে তেজি শেয়ারবাজারকে ষাঁড়ের ক্ষিপ্ততার সঙ্গে তুলনা করেন। আর ভালুক নাকি বেশির ভাগ সময়ই মাথা নিচু করে থাকে। এ কারণে অনেক মন্দা বা পড়তি বাজারকে ভালুকের সঙ্গে তুলনা করেন।

ইপিএস দিয়ে কী করবেন

শেয়ারবাজারের কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনার আগে ওই কোম্পানির আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নেওয়া খুবই জরুরি। একেকটি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অনেক তথ্য থাকে। সব তথ্য জানা–বোঝা সবার পক্ষে সম্ভবও নয়। তবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনাবেচার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যেসব তথ্যের পেছনে ছোটেন, তার একটি শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস। যদি শেয়ারবাজার নিয়ে আপনার কোনো ধারণা না থাকে, তাহলে আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ইপিএস—এটি আবার কী? হ্যাঁ, আপনার জন্যই বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি। একটি কোম্পানি নির্দিষ্ট একটি সময়ে সব খরচ বাদ দেওয়ার পর যে মুনাফা করে, তার ভিত্তিতেই ওই কোম্পানির ইপিএস হিসাব করা হয়। সহজেই বের করা যায় এ হিসাব। ধরা যাক, ২০২০ সালে সব খরচ বাদ দেওয়ার পর ‘এ’ কোম্পানির মুনাফা হয়েছে ১ কোটি টাকা। ওই কোম্পানির মোট শেয়ার রয়েছে ১০ লাখ। তাতে ২০২০ সাল শেষে ‘এ’ কোম্পানির ইপিএস দাঁড়াবে ১০ টাকা। কোম্পানির মুনাফাকে মোট শেয়ারসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে ইপিএস বের করা হয়।

এখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ইপিএসটা জানা কেন জরুরি? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হচ্ছে, আপনার হাতে যে কোম্পানির শেয়ার আছে, তার বিপরীতে ওই কোম্পানির আয় কেমন, তা জানাটা আপনার জন্য অবশ্যই জরুরি। কারণ, ইপিএসের জন্যই শেয়ারের দামের কম-বেশি হয়। ইপিএস বাড়লে শেয়ারের দাম বাড়ে, আর ইপিএস কমলে দাম কমে। আবার ইপিএসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও। সেই পিই রেশিওর ভিত্তিতে শেয়ারের বিপরীতে ঋণপ্রাপ্তি নির্ভর করে। সহজ করে বললে ইপিএস ভালো মানে কোম্পানির ব্যবসা ভালো, আর ইপিএস খারাপ মানে ব্যবসা খারাপ। তাই ভালো ব্যবসা করা কোম্পানির শেয়ার কিনবেন নাকি ব্যবসায় খারাপ করা কোম্পানির শেয়ার কিনবেন—সিদ্ধান্ত আপনার।

পিই রেশিওতে কী হয়

বাংলাদেশের বাজারে শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে আপনি ঋণ পাবেন কি পাবেন না, তা নির্ভর করছে ওই কোম্পানির পিই রেশিও কত তার ওপর। বর্তমানে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো কোম্পানির পিই রেশিও ৪০-র বেশি হলেই ওই কোম্পানির শেয়ার ঋণ অযোগ্য। তবে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান চাইলে আরও কম পিই রেশিওর কোম্পানিকেও ঋণ অযোগ্য বিবেচিত করতে পারে। সেটি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। ঋণ পাওয়া না পাওয়ার আগে পিই রেশিওর মানে কী? কোনো একটি কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাতকে সংক্ষেপে পিই রেশিও বলা হয়। এটি নির্ধারিত হয় সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ারের বাজারমূল্য ও ইপিএসের ভিত্তিতে। ধরা যাক, ২০২০ সাল শেষে ‘এ’ কোম্পানির শেয়ারের ইপিএস দাঁড়িয়েছে ১০ টাকা। কোম্পানিটির শেয়ারের বাজারমূল্য ২০০ টাকা। তাহলে ২০২০ সাল শেষে ওই কোম্পানির পিই রেশিও দাঁড়াবে ২০-এ। অর্থাৎ কোম্পানির ইপিএস দিয়ে শেয়ারের বাজারমূল্যকে ভাগ দিলে যে ভাগফল পাওয়া যায়, সেটিই ওই কোম্পানির পিই রেশিও। নিরীক্ষিত ও অনিরীক্ষিত—এ দুই আর্থিক প্রতিবেদনের ইপিএসের ভিত্তিতে পিই রেশিও নির্ণয় করা হয়। সাধারণত শেয়ারবাজার বিশ্লেষকেরা বলে থাকেন যে কোম্পানির পিই রেশিও যত কম, সেই কোম্পানি বিনিয়োগের জন্য ততটাই উত্তম। বিষয়টি আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলা যাক তবে। ধরি, ‘এ’ কোম্পানির পিই রেশিও ২০। তার মানে, যদি কোম্পানিটির অন্যান্য অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হয় এবং আয়ের এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যায়, তবে একজন বিনিয়োগকারী ২০ বছরে তার বিনিয়োগের পুরো অর্থ ফেরত পাবেন। তবে সব ক্ষেত্রে কম পিই মানেই বিনিয়োগযোগ্য শেয়ার নয়, বন্ধ কোম্পানিরও অনেক সময় পিই অনেক কম থাকে।

 

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • বৃহস্পতিবার (সন্ধ্যা ৭:৩৫)
  • ২৮শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১৮ই রমজান, ১৪৪৫ হিজরি
  • ১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ (বসন্তকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com