নেহার কু-কর্ম ফাঁসে বাকি ডিজে তরুণীদের সর্বনাশ

রাজধানীর বনানীর ব্লক এফের ৫২ নম্বর বাড়ি। বাইরের অংশ পুরনো হলেও ৬ তলা বাড়িটির ভেতরে কয়েকটি কর্পোরেট অফিস বেশ চাকচিক্যময়। এই বাড়ির চারতলায় আছে একটি অখ্যাত প্রোডাকশন হাউজ।

আসলে প্রোডাকশন হাউজের আড়ালেই এখানেই প্রাইভেট ডিজের আসর বসে। যেখানে উঠতি মডেল থেকে শুরু করে আনা হয় নায়িকাদের। আর আসরে আসেন বিত্তবানদের সন্তান থেকে শুরু করে সমাজের নামিদামি ব্যক্তিরা। সপ্তাহের প্রায় ৩/৪ দিন ডিজের আসর জমানো হয়। ডিজের পাশাপাশি অনৈতিক কর্মকাণ্ডও চলে। আবার সেখানে গেস্টদের ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইলও করা হয়।

শুধু এই বাড়িটিতেই নয়, বনানী গুলশান, নিকেতনের প্রায় শতাধিক বাড়িকে ঘিরে প্রাইভেট ডিজের জমজমাট আসর বসছে প্রতিনিয়ত। যেখানে ডিজের পাশাপাশি অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে। একটি চক্র ডিজের আসর বসিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর এ সব ডিজেতেই মদ ও উদ্যাম নৃত্যের পাশাপাশি চলে অনৈতিক কর্মকাণ্ড।

সম্প্রতি ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মারা যাওয়ার ঘটনার পর সক্রিয় হয়ে উঠেছে পুলিশ। গুলশান, বনানী, নিকেতন, উত্তরা এলাকায় এসব ডিজের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছেন তারা। বিশেষ করে এ রকম প্রাইভেট ডিজের বিরুদ্ধে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। সাদাপোশাকেও  চলছে নজরদারী।

গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, এ এলাকাগুলোতে এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধে পুলিশ বদ্ধ পরিকর। আমরা এরইমধ্যে নজরদারী শুরু করেছি। অনেক স্থানে অভিযানও হয়েছে।

উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার শহিদুল্লাহ বলেন, উত্তরার বিভিন্ন এলাকায় এ রকম প্রাইভেট ডিজের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। যেখানেই এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যাবে সেখানেই আমরা অভিযান চালাবো।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর অভিজাত এলাকা কেন্দ্রিক এ ধরনের পার্টি বন্ধ হয়ে যায়। হামলার আগে ওয়েস্টিন, সুইটড্রিম, সারিনাসহ বেশকিছু অভিযাত হোটেলে ডিজে পার্টি হতো। কিন্তু হামলার ঘটনার পর থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে এগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে এ চক্র প্রাইভেট আয়োজন শুরু করে।

পার্টিগুলোতে মূলত বিত্তবানদের এবং অভিজাত ছেলে-মেয়েদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। মদ ও ডিজেদের দ্বারা উদ্যম নৃত্যের ব্যবস্থাসহ অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য সব ব্যবস্থা করতো আয়োজকরা।

জানা যায়, মহামারি চলাকালীন মদ আমদানীতে কিছুটা ভাটা পড়লে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভেজাল মদ তৈরী করতে শুরু করে। আর এসব মদ রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ভেজাল মদ পানে একেক করে মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। গত এক মাসে সারাদেশে অর্ধশতাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

একদিকে যেমন ভেজাল মদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়, অন্যদিকে শুরু হয় ডিজের নামে অনৈতিক পার্টির বিরুদ্ধে অভিযান। এরই মধ্যে ইউল্যাবের ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় আটক ডিজে নেহাকে রিমান্ডে আনার পর অনৈতিক এ পার্টি সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে।

ডিজে নেহা আটকের পর পুলিশি অভিযান বৃদ্ধির ফলে রাজধানীর অধিকাংশই স্থানে এখন প্রাইভেট ডিজে বন্ধ হয়ে গেছে। ডিজে নেহার মতই আরো এ রকম শতাধিক তরুণী বা ডিজের অন্ধকার জীবন রয়েছে। যারা রাতের বেলায় এ রকম পার্টিতে মত্ত থাকে। এদের কাজই হলো বিত্তবানদের টার্গেট করে পার্টিতে গেস্ট করা। নানা কলা কৌশলে এ ধরনের গেস্টের কাছ থেকে টাকা হাতানোই মূল কৌশল। আবার অনেক সময় পার্টিতে ডেকে এনে গোপনে ভিডিও ধারণ করে পরবর্তীতে ব্ল্যাক মেইল করে।

ডিজে নেহার অন্ধকার জীবন

ডিজে পার্টি, মদ পার্টি কিংবা শিশা লাউঞ্জের রঙিন জগতের আলো-আঁধারে ডিজে নেহার অন্যতম টার্গেট ছিলো শিল্পপতি কিংবা তাদের সন্তানরা। হাতের নাগালে কোনো শিল্পপতি পেয়ে গেলেই যেনো কপাল খুলে যেতো তার। কলাকৌশলে বিভিন্ন রকমের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেই জায়গা করে নিতো টার্গেটকৃতদের মনে।

নেহার ব্লাকমেইলিংয়ের কবলে পড়েছেন দেশের শীর্ষ পর্যায়ের শিল্পপতিও। এছাড়া রয়েছেন ঢাকা এবং চট্টগ্রামের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক গাড়ি ব্যবসায়ী। শিল্পপতিদের মনের গভীরে জায়গা করে নিতে প্রয়োজনে দেহ বিলিয়ে দিতে কার্পণ্য করতো না নেহা। প্রয়োজনে তার আওতায় থাকা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দরী তরুণীদের ম্যানেজ করে ওই শিল্পপতিদের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ করে দিতো এই নেহা। এর বিনিময়ে হাতিয়ে নিতো মোটা অংকের টাকা কিংবা দামি গিফট।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের সন্তুষ্ট রাখতো ডিজে, মদ এবং শিশা পার্টিতে দাওয়াত দিয়ে। এদিকে শিল্পপতিদের সঙ্গে ওইসব একান্তের ছবি কিংবা ভিডিও গোপনে ধারণ করে নিজ সংরক্ষণে রাখতো নেহা।

একই সময়ে সংগ্রহ করে ফেলতো ওইসব শিল্পপতির মুঠোফোন নম্বর, যে প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে যেতো তাদের ফেসবুকসহ অন্যান্য অনলাইন মাধ্যমে। ওই শিল্পপতিদের ফেসুবকসহ অন্যান্য অনলাইন মাধ্যম ঘেঁটে একে একে যোগাড় করতো তাদের বাবা-মা, স্ত্রী কিংবা নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের উসিলায়। আবার এই তালিকা থেকেই অনলাইনে আরো শিকার খুঁজে বেড়াতো সে।

কে এই বিশাল?

এসব কু-কর্মে তার সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করতো তারই খালাতো ভাই শাফায়াত জামিল বিশাল। তার পুরো নাম শাফায়াত জামিল বিশাল। এই তরুণ অপকর্মের মহারাণী খ্যাত ডিজে নেহা বা কুইন নেহার সম্পর্কে খালাতো ভাই। বিশাল নেহার ডান হাত হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো। বিশাল প্রায় সার্বক্ষণিকই নেহার সঙ্গে থাকতো।

নেহা তার মুঠোফোনে টার্গেটকৃতদের নাম সংরক্ষণ করতে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতো। বিশাল নেহার ক্লায়েন্টদের তালিকা সংরক্ষণ করতো। এছাড়াও অবৈধ দরদামে সে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দায়িত্বপালন করতো।

জানা যায়, ২০২০ সালের মার্চে নেহার সঙ্গে চট্টগ্রামের এক গাড়ি ব্যবসায়ীর পরিচয় ঘটে। এর এক পর্যায়ে ওই ব্যবসায়ীকে একান্ত সম্পর্কে জড়িয়ে ইমোশনাল ব্লাকমেইলিং করতে থাকে। ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে গত মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত, ৬ মাসে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।

চট্টগ্রামের ওই গাড়ি ব্যবসায়ীর ফেসবুক থেকে নেহার পরিচয় হয় ঢাকার এক গাড়ি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। এই দুই গাড়ি ব্যবসায়ী একে অপরের বন্ধু। চট্টগ্রামের বন্ধুকে নেহা যে ব্লাইমেইলিং করেছে তা ঢাকার এই বন্ধু পরে টের পায়। তবে এরইমধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার এই গাড়ি ব্যবসায়ীকেও একই রকমের ফাঁদে ফেলে ৪ মাসে ১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এসব টাকা বিকাশসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় হাতিয়ে নেয়নেহা। এছাড়াও এই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বর যমুনা ফিউচার পার্ক শপিং মলের একটি মোবাইলের দোকান থেকে পছন্দের ‘আইফোন টুয়েলভ প্রো ম্যাক্স’ গিফট নিয়েছে নেহা।

ডিজে নেহার সঙ্গে কার্লোসের সখ্যতা:

২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকায় গ্রেফতার হয়েছিলো ‘আবু জাফর মোহাম্মদ কার্লোস’ নামের আন্তর্জাতিক ইয়াবা ব্যবসায়ী। সে ইয়াবা ডন কার্লোস নামেও পরিচিত। তার সঙ্গে জড়িয়ে আলোচনায় উঠে আসে বেশ কয়েকজন মডেল ও অভিনেত্রীর নাম।

অনন্য মামুন পরিচালিত ‘অস্তিত্ব’ চলচ্চিত্রের প্রযোজক কার্লোস। অস্তিত্ব সিনেমা বানানোর পর কার্লোস ঢাকার সিনেমা পাড়ার নামি-দামি নায়িকাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এসব নায়িকার অনেককে নিয়ে তিনি থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় যাতায়াত শুরু করেন। এদের কয়েক জনের সঙ্গে তিনি লিভ টুগেদারও করছিলেন। এই কার্লোসও ডিজে নেহার খুব কাছের এবং ঘনিষ্ঠ একজন ছিলো বলে জানা গেছে।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • শুক্রবার (দুপুর ২:৫০)
  • ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com