লক্ষ্য নির্ধারণে বাস্তববাদী হওয়া জরুরি

দশ জন হাইস্কুল শিক্ষার্থীর কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়—তোমার জীবনের লক্ষ্য কী? তারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী কিংবা অন্যকিছু হতে চাইবে। কিন্তু জীবিকা নির্বাহের জন্য গৃহীত পেশা কি মানুষের ‘জীবনের লক্ষ্য’ হতে পারে? তা ছাড়া একজন মানুষ সমগ্র জীবনে একটামাত্র পেশাই গ্রহণ করবে, সেটাই বা ভাবতে হবে কেন? কিন্তু আমাদের দেশে শৈশব ও কৈশোরে দৃঢ়ভাবে মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে, বিশেষ কোনো পেশায় যাওয়াই জীবনের চরম সফলতা। ফলে কোনো কারণে তা অর্জনে ব্যর্থ হলে অনেকেই ভেঙে পড়ে। জীবন কি এত ক্ষুদ্র ব্যাপার যে, শুধু পেশা দিয়ে তার সফলতা বা ব্যর্থতা নির্ধারিত হবে?

বিপুল জনগোষ্ঠীর এই দেশে কোনো মতে একটা চাকরি পেলেই জীবন ধন্য হবে—এমন ভাবনা অধিকাংশ মা-বাবা ও শিক্ষার্থী লালন করেন। পাশাপাশি সারা জীবন একটা চাকরি করার আকাঙ্ক্ষাও প্রবল। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে বুঝি সেটা আঁকড়ে থাকার দিন দ্রুতই শেষ হতে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সারা জীবনে একজন মানুষ গড়ে ১৪টি জব করে। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ঈর্ষণীয় পদে কর্মরত থাকাবস্থায় জব হারানো খুব স্বাভাবিক এক প্রক্রিয়া। অথচ আমরা পার্মানেন্ট চাকরির আশায় জীবনের সবচেয়ে সোনালি সময়গুলো নষ্ট করি।

আজ যে তরুণ ভাবছে অমুক চাকরিটা পেলেই জীবনের চরম লক্ষ্য অর্জন হবে, তারপর জীবনে খালি সুখ আর সুখ—ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। যারা এখনো সেই পথে হাঁটেনি বা অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি, তারাই তেমন কল্পরাজ্যে ভাসতে পারে। পেশাগত লক্ষ্য থাকা ভালো। তদানুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করা যায়। ক্রমান্বয়ে সেই পথে অগ্রসর হলে মানসিক তৃপ্তি মেলে। কিন্তু সেটাই সব নয়—এই বোধটাও স্পষ্ট হওয়া দরকার।

প্রত্যাশামাফিক জব পাওয়ার সফলতা কত দ্রুত ফিকে হয়ে যায়, তা বোঝার জন্য ১০ বছরেও প্রমোশন না পাওয়া একজন সরকারি কলেজের শিক্ষক কিংবা ২২ বছর পরেও সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত একজন ডাক্তারের সঙ্গে একান্তে কথা বলে দেখবেন। আপনি যাকে বিরাট সফলতা ভাবছেন, ঠিক সেই পজিশনে দাঁড়িয়ে তিনি কতটা হতাশ ও বিরক্ত! যারা ভাবছেন প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডারে গেলে বুঝি শুধু সুখ আর সুখ, সত্যিই কী তাই? খুব সম্ভবত, না। দুনিয়ার কোনো পেশাতেই নিরবচ্ছিন্ন সুখ নেই। জীবনের জন্য একসময় মানিয়ে নিতে হয়। তাই শত সমস্যা নিয়েও তারা হাসিমুখে দায়িত্ব পালন করেন, করতে হয়।

আমার এক বন্ধু ছাত্রজীবনে বিয়ে করায় (এমনকি সন্তানের বাবা হওয়ায়) বেচারা আর্থিকভাবে খুব দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। পাশ করার পরে কিছুদিন এক চাকরিতে ছিল। কিন্তু তার বেতন-ভাতার তুলনায় কাজের চাপে নাভিশ্বাস অবস্থা। এক ভার্সিটিতে আবেদনের পর আমরা খুব চেষ্টা করলাম যেন তার চাকরিটা হয়। তার রেজাল্ট খুব ভালো ছিল, তাই সমস্যা হলো না। চাকরিতে যোগদানের সময় তার মনে হয়েছিল, আকাশের চাঁদটা বুঝি তার হাতে ধরা দিল।

নানা ব্যস্ততায় মাসখানেক তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। তারপর সাক্ষাতে একদিন জানতে চাইলাম, চাকরি কেমন চলছে? বিলিভ মি, সে এমন বিরক্ত এক ভঙ্গিতে বলল, ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা আর কামলা খাটা একই কথা! অর্থাত্, সে নাকি কাজের চাপে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে এই তার অনুভূতি! কেন এমনটা হয়? কারণ একটা লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই নতুন অসংখ্য চাওয়া হাজির হয়। তখন পূর্বের অর্জনগুলো উপভোগ করার ফুরসতও মেলে না!

মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, পেশাগত লক্ষ্য কেন বদলায়? তাছাড়া সত্যিই তা বদলানো উচিত কি না? আমার দৃষ্টিতে সেটা বদলানোই স্বাভাবিক ও সৌন্দর্যময়। কেউ যদি জীবনে শুধু একটা পেশায় যাওয়ার জন্য ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা সবকিছু বিনিয়োগ করে…ধরে নিলাম সেটা অর্জিত হলো, তারপর? ২৫ বছর বয়সে একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিসিএস ক্যাডার হয়ে গেল। তার পরে কি তার জীবন থেমে যাবে? কারণ তত্ত্ব মোতাবেক সে তো পেশাগত লক্ষ্য অর্জন করে ফেলেছে, তাই না?

ব্যাপারটা বাস্তবে তেমন হয় না। তাই বিশেষ কোনো পেশায় যাওয়া জীবনের লক্ষ্যের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। কারণ যে ছেলে বা মেয়েটা মেডিক্যালে বা বুয়েটে পড়ার জন্য জীবনের সর্বোচ্চটা চেষ্টা করল, হলো না। তার জীবন কি অর্থহীন হয়ে যাবে? অবশ্যই না।

গতদিন ফেসবুকে এক ছবি দেখলাম। এক শিক্ষার্থী তার পড়ার টেবিলের সামনে বোর্ডে বড় করে লিখে রেখেছে—জুলেখাকে বিয়ে করার জন্য বিসিএসে সফল হতেই হবে। তাহলে তার জীবনের লক্ষ্য কোনটা— বিসিএস ক্যাডার হওয়া, নাকি জুলেখাকে বিয়ে করা? প্রথমে ক্যাডার হওয়ার লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই তার লক্ষ্য হবে বিয়ে করা। সেটা অর্জনের পর কি সবকিছু থেমে যাবে? না, তখন তার ক্যারিয়ারে উন্নতি, বাচ্চাকাচ্চা নেওয়া, বিদেশে ডিগ্রি করা—এমন অসংখ্য লক্ষ্যের পেছনে ছুটতে থাকবে। তাই এর কোনো শেষ নেই। নিরন্তর ছুটে চলাই জীবন। এর কিছুসংখ্যক অর্জন হবে, বাকিগুলো হবে না—এভাবেই একদিন আমাদের জন্য নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাবে।

মাঝেমধ্যে ভাবি, আসলে আমাদের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে কিছু আছে কি? শিশুকাল থেকে নানান প্রেক্ষিত ও বাস্তবতায় আমরা সাময়িক কিছু অর্জনের লক্ষ্য স্থির করি। সেটা অর্জনে সচেষ্ট থাকি। তবে সংগত কারণেই তা বদলায়। হয়তো সে কারণেই বুঝতে শেখার পর থেকে মেডিক্যালে পড়ার স্বপ্নে বিভোর ছেলেটা ডাক্তার হওয়ার প্রাক্কালে আবার বিসিএসের গাইড নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে! তবু পেশাগত লক্ষ্যকে ‘জীবনের লক্ষ্য’ বলে অনেকে ভুল করি। তাই বলে কোনো লক্ষ্য থাকবে না? অবশ্যই থাকবে। তবে স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যের পেছনে মনোযোগী হওয়া কল্যাণকর। তাতে পরিশ্রমের পাশাপাশি অর্জনগুলো উপভোগ করা যায়। তা আমাদের আরো কঠোর পরিশ্রমে উত্সাহিত করে। বিষয়টা ক্রিকেটের বড় কোনো টুর্নামেন্ট খেলার মতো। শুধু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্নে বিভোর না হয়ে প্রতিটি ম্যাচ জেতার লক্ষ্য ঠিক করা দরকার। এমনকি প্রতিটি ওভার সম্পর্কিত লক্ষ্য ঠিক করা জরুরি।

আগামীকাল কী ঘটবে তা আমরা কেউ জানি না। তাই লক্ষ্য নির্ধারণে বাস্তববাদী হওয়া জরুরি। কিন্তু আমাদের চারপাশে যুক্তির চেয়ে আবেগকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। পেশাগত লক্ষ্য নির্ধারণও তার ব্যতিক্রম নয়। একটা শিশু আজ থেকে ২০-২৫ বছর পর কোন পেশায় যাবে, তা আজই ঠিক করে দেওয়া কতটা অবাস্তব, কল্পনা করা যায়?

আরেকটা বিষয় হলো, ‘আমার জন্মই হয়েছে চাকরি করার জন্য’ এমন মানসিকতা লালন করা লোকের সংখ্যা চারপাশে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকের মনোভাব এমন, যে কোনো মূল্যে একটা চাকরি চায়। ফলে চাকরির নামে প্রতারণার সুযোগ বাড়ছে। অখ্যাত ও ভুঁইফোঁড় নানা সংস্থা তাদের ব্যবহার করে প্রতারণার ফাঁদ পাতছে। তাছাড়া অসংখ্য কাজকে আমাদের সমাজ ‘ছোট কাজ’ ট্যাগ দিয়ে, সেগুলো শিক্ষিতদের জন্য নয়—এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ফলে উচ্চশিক্ষিতরা বছরের পর বছর বেকার থাকেন। আর তুলনামূলকভাবে কম লেখাপড়া জানা লোকদের দাপট বাড়তে থাকে। তবু শিক্ষিতরা কোনো কাজে হাত দিতে রাজি নন। এভাবেই একসময় তাদের কাজ করার মানসিকতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। মাথার চুল, চোখের জ্যোতি, তারুণ্যের শক্তি ও মনোভাব বিদায় নেওয়ার পরে তখন অনেকেই ‘একটা কিছু’ করতে চান। কিন্তু তখন সামগ্রিক বাস্তবতা আর তাকে সাহায্য করতে পারে না। দ্য বয়লিং ফ্রগসিনড্রোমে ভুগে জীবন শেষ হয়। একসময় শুধু ভাগ্যকে দোষারোপ করে। তাহলে করণীয় কী? আমার মতে, খুব দূরে না তাকানোই ভালো। কারণ আজ কেউ যদি গুগল বা ফেসবুকে জব পান, সবাই তাকে বাহবা দেয়। কিন্তু তার শৈশবে তো গুগল বা ফেসবুকের অস্তিত্বই ছিল না! তাই বহু বছর পরে কী হবে, তা নিয়ে আকাশ-পাতাল না ভেবে নিজের বিদ্যমান বাস্তবতায় ‘আমি কী করতে পারি’ সে ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া দরকার।

বর্তমান শিক্ষার্থীদের বলব, আমরা মহামারিজনিত কারণে অনিশ্চিত এক পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হচ্ছি। তাই শুধু সনদের প্রতি মনোযোগী না থেকে দক্ষতা অর্জনে মনোযোগী হওয়া দরকার। অনলাইনে অসংখ্য কোর্স করার সুযোগ রয়েছে। নিজের পছন্দের কিছু কোর্স করো, সঙ্গে বাস্তব জ্ঞান আহরণে মনোযোগী হও। নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য লেগে থাকো। আজকের দিনটা, আগামী এক সপ্তাহ কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে ভাবাটা জরুরি।

তুমি পাঁচ বা দশ বছর পরে কী করবে, তা ভেবে অস্থির হওয়ার দরকার নেই। কারণ আজ থেকে দুই বছর আগে কেউ জানত করোনা নামের এক ভাইরাস এসে গোটা দুনিয়াকে স্তব্ধ করে দেবে? তাহলে আজ থেকে দুই বছর পরে সত্যিই কী ঘটবে, তা আমরা কেউ জানি না। তাই বর্তমানকে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রসর হওয়া দরকার।

আরেকটা বিষয়ে মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। সেটা হলো, পড়ালেখা শেষ করে কর্মজীবন শুরু করা। এই ধারণা বদলাতে হবে। বিদেশে পড়তে গিয়ে পেট্রলপাম্পে জব করার কথা শুনে আপ্লুত হই। অথচ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এক শিক্ষার্থীর পার্শেল ডেলিভারি দেওয়া দেখে আমরা আকাশ থেকে পড়ি! অথচ এই কাজের মাধ্যমে সে জীবনের জন্য দরকারি অসংখ্য গুণাবলি অর্জন করতে পারে।

চারপাশের লোকজন সমালোচনা করে তাকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। একজন তরুণ যত বেশি মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ পাবে, কর্মজীবনের জন্য সে তত বেশি তৈরি হবে। তাই আমার পরিচিতদের বলি, কোনো কাজ না পেলে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোতে কাজ করো। সেখানে অর্থ না পেলেও অসংখ্য মানবীয় গুণাবলি অর্জন করতে পারবে, যা তোমাকে সারা জীবন সাহায্য করবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একজন তরুণ গায়ে প্রচণ্ড শক্তি, মাথায় বুদ্ধি নিয়ে কোনো একটা কাজে নেমে পড়লে, সফলতা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • শুক্রবার (দুপুর ১২:৩৭)
  • ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com