দেয়ালেও ক্যামেরা আছে!

আগে দেয়ালের শুধু কান ছিল। এখন দেয়ালে ক্যামেরাও আছে! গোপন কথাটা বহু কারণে তাই এখন আর থাকে না গোপনে। প্রযুক্তিহীনতার কারণে আগে হয়তো অনেক কিছু গোপন থাকতো, তবে প্রতিহিংসার কারণে কিছু কিছু জিনিস ফাঁস হয়ে যেতো। যেমন যার সঙ্গে প্রেম করতেন, তার বিয়ে হয়ে গেলো অন্য কারও সঙ্গে। আপনি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে প্রেমিকার সঙ্গে তোলা ছবি এবং ফটো পাঠিয়ে দিলেন প্রেমিকার স্বামীর কাছে। এখন সময় বদলেছে। এখন ফাঁস করা হয় প্রেমিকার সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও। এই ভিডিও ফাঁস করার ক্ষেত্রে নায়িকা থেকে ডিসি, পিয়ন থেকে শুরু করে ক্যাডার বা মাদক বিক্রেতা কেউই বাদ পড়ছেন না! ধরুন, চেয়ারম্যানের সঙ্গে মিলে আপনি কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের গম বাইরে বিক্রি করে টাকা কামাতে থাকলেন। এক সময় আপনার মনে হলো, চেয়ারম্যান আপনাকে ঠকাচ্ছেন। আপনি গম বিক্রি করার প্রমাণাদি সাংবাদিক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে জানালেন। একদিন গ্রেফতার হয়ে গেলেন চেয়ারম্যান। আগে ফাঁস হতো এভাবেই।

এসব ছোটখাটো ঘটনার মতো আগে বড় বড় ঘটনাও যে ফাঁস হয়ে যেতো না, তা নয়। তবে পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি হিসেবে আজও বিবেচিত হয় ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি। এছাড়া সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি ক্লিনটন ও মনিকা লিউনিস্কির ঘটনাটিও বেশি আলোচিত। ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ওয়াটারগেট কমপ্লেক্সে ডেমোক্রেটিক পার্টির অফিসে আড়ি পেতেছিলেন ওই সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সহকারী ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের কয়েকজন। ১৯৭২-৭৩ সালে এই ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে হইচই শুরু হয়। এরফলে পদত্যাগ করতে হয় রিচার্ড নিক্সনকে। বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টেইন নামের দুই সাংবাদিক এই সংবাদ প্রথম প্রকাশ করেন ও পরে ধারাবাহিক রিপোর্ট করে পৃথিবীব্যাপী হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। আগে এভাবেও ফাঁস হতো অনেক কিছু, যার ধারাবাহিকতা আরও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখেছি। এসব ফাঁস করা হতো মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে।

এরকম ফাঁস করে দেওয়ার আরেক কাহিনির নাম ‘পানামা পেপারস লিক’। তারা এ পর্যন্ত ১ কোটি ১৫ লাখ নথি প্রকাশ বা ফাঁস করেছে। সেখানে ৩৮টি দেশের রাজনীতিবিদ, সাবেক ও বর্তমান ৭২ জন প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের নিজ দেশের অর্থ ও সম্পদ লুণ্ঠনের খবর রয়েছে। যে যেভাবে সুযোগ পায় সে সেভাবেই হয়তো নিজের আখের গোছায়। এলাকার চেয়ারম্যান সুযোগ বুঝে বিক্রি করে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির গম আর রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীরা কুক্ষিগত করে দেশের অর্থ-সম্পদ। পানামা পেপারসের নথিতে রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান পুতিনের ২০০ কোটি ডলারের গোপন অর্থের সন্ধান দেওয়া হয়েছে। পুতিনের কিছু না হলেও এই তালিকায় নাম এসেছিল আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও নওয়াজ শরিফের পরিবারের সদস্যদের। ইতোমধ্যে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, আদালতের রায়ে নওয়াজ শরিফ রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছেন। আইভরি কোস্ট, অ্যাঙ্গোলা, সিরিয়া, চীনের শি জিন পিংয়ের পরিবার, মেক্সিকোর ড্রাগ লর্ডস, সৌদি আরবের বাদশা, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট, ভারতের অমিতাভ বচ্চনের পরিবারসহ বাংলাদেশেরও ৮২ জনের নাম ছিল পানামা পেপারসে। যারা পানামা পেপারসে বিভিন্ন দেশের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট অথবা ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রকাশ করেছেন, তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এই কাজ করেননি। তারা নিঃসন্দেহে মহৎ কাজ করেছেন। নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জানার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতেই তারা এই ‘লিক’ করেছেন।

পানামা পেপারসের মতো উইকিলিকসের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে হইচই ফেলে দিয়েছে আর একজন মানুষ। তিনি পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছেন। এই মানুষটির নাম জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। অ্যামেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ডের মতো বড় বড় সাম্রাজ্যবাদী দেশের মানবতাবিরোধী কার্যক্রম, দুর্নীতি আর হত্যাযজ্ঞের বাস্তব চরিত্র তুলে ধরেছেন অ্যাসাঞ্জ। একইসঙ্গে সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষের দৈনিক পত্রিকা বা টেলিভিশনগুলোর মুখোশ উন্মোচন করছেন সুন্দরভাবে। অ্যাসাঞ্জ স্পষ্টভাবেই তুলে ধরেছেন, ইরাকে কথিত কোনও পারমাণবিক অস্ত্র পাওয়া যায়নি। অ্যাসাঞ্জ উল্লেখ করেছেন, ২০০৩ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকা ও মিত্রবাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন এক লাখের বেশি মানুষ। যাদের ৬৭ ভাগ মানুষই বেসামরিক ও উল্লেখযোগ্য হারে নারী ও শিশুরা মারা গিয়েছেন। পঙ্গু হয়েছেন কয়েক লাখ মানুষ! আমেরিকা আর তার দোসররা ইরাক ও লিবিয়াকে যে দোজখ বানিয়ে ছেড়েছে এবং এই দুই দেশে তাদের কারণে প্রতিদিন যে অগণিত মানুষ মারা যাচ্ছেন, অস্থিতিশীলতা ও ভঙ্গুর অর্থনীতির কারণে যে দেশ দুটো একশত বছর পিছিয়ে গেছে, সেসব কথা তারা কখনও প্রকাশিত হতে দেয় না। মানুষের জানার অধিকারের যে সাহসী সাংবাদিকতা, অ্যাসাঞ্জের জন্য সেটাই অপরাধ, কারণ আমেরিকা ইংল্যান্ড এর প্রিয় ‘অ্যামবেডেড জার্নালিজম’ যেখানে আমেরিকান বাহিনীর সঙ্গে ট্যাংকে চড়ে সাংবাদিকরা গিয়ে ইরাকের মানুষের বিপক্ষে এবং আগ্রাসনকারী আমেরিকার পক্ষে কথা বলে। আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধবিরোধী প্রচারণা প্রায় চলে না। উল্টো বিবিসি, সিএনএন, এবিসি বা ফক্স নিউজ ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তানের কথিত যুদ্ধ কাভারেজ করতে গিয়ে কয়েক মিলিয়ন ডলার আয় করে। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ তাই আমেরিকার কাছে কোনও সাংবাদিকই নন। ইকুয়েডরের কাছে একদা অ্যাসাঞ্জ ছিলেন নায়ক, ক্ষমতার পালাবদলের পর (আমেরিকা সমর্থিত সরকার এখন ইকুয়েডরে) এখন তিনি খলনায়ক। স্বেচ্ছায় অন্তরঙ্গ সম্পর্ক করার পরেও নথি ফাঁস করে দেওয়ার কারণে দুই বছর পরে দুই নারী অভিযোগ করেন অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে আর সুইডেনের কাছে অ্যাসাঞ্জ হয়ে যান ‘ধর্ষক’! ইকুয়েডর বা ইংল্যান্ডের কাছে অ্যাসাঞ্জ গুরুতর অপরাধী আর আমেরিকার কাছে স্রেফ হ্যাকার!

তবে তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার ক্ষেত্রে হ্যাকিং ও হ্যাকাররা চলে এসেছে সার্বক্ষণিক আলোচনায়। হ্যাকিং করে যারা তথ্য ফাঁস করেন, তাদের উদ্দেশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহৎ নয়। উল্টো টাকা কামাই করার প্রচেষ্টা মাত্র। একসময়ের মেইল সেবা কার্যক্রমের সাড়া জাগানো প্রতিষ্ঠান ইয়াহুকে ২০১৬ সালে কিনে নেয় ভেরিজন। এরপর ভেরিজন এক তদন্তে জানায় ৩০০ কোটি মানুষের মেইল সমৃদ্ধ ইয়াহু কোম্পানি হ্যাকিংয়ের কবলে পড়েছিল, যা তারা টেরই পায়নি! হ্যাকাররা অনেক সময় রসিকতা করতেও পছন্দ করে। ক্যালিফোর্নিয়ার জনপ্রিয় ‘সেক্সসাইট’ অ্যাডাল্ট ফ্রেন্ড ফাইন্ডার ২০১৬ সালে হ্যাকারদের পাল্লায় পড়ে। সাড়ে ছয় কোটি গ্রাহক সমৃদ্ধ অ্যাডাল্ট ফ্রেন্ড ফাইন্ডারের ৪১ কোটি মানুষের তথ্য চুরি করতে সমর্থ হয় হ্যাকাররা। ব্ল্যাকমেইলের বড় উদাহরণ এটা। সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় অনলাইন পরিবহন কোম্পানি উবারও পড়েছিল হ্যাকারদের পাল্লায়। উবারের ভান্ডারে থাকা প্রায় সাত কোটি মানুষের নাম ঠিকানা টেলিফোন নম্বর চুরি করে নেয় হ্যাকাররা, উবারকে ফেলে দেয় সীমাহীন ভোগান্তিতে!

তথ্য ফাঁসের এই দুনিয়ায় ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও মানুষ পড়ছে সীমাহীন ভোগান্তিতে। গোপন কিছু আর গোপন থাকছে না। ফাঁস হওয়া ঘটনার জের ধরে কারও কারও ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে নেমে আসতে পারে সীমাহীন হতাশা, কখনও কখনও আত্মহত্যা করার ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। বন্ধুর সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভিডিও প্রকাশের পর আত্মহত্যা করেছে এমন কিশোরী বা তরুণীর সংখ্যা এই দেশে একদম কম নয়। সারা পৃথিবীতে ব্যক্তি জীবনের গোপন ঘটনার ভিডিও প্রকাশ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। জনপ্রিয় অভিনেতা, খেলোয়াড়, গায়ক, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বা রাজনীতিবিদদের গোপন কর্মকাণ্ডের এমন ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে। এসব নিয়ে সরস আলোচনা হচ্ছে, আর যাদের ভিডিও ফাঁস হচ্ছে তাদের জীবনটা আজীবনের জন্য যেন থমকে যাচ্ছে।

আমেরিকার শিকাগো শহরের এক অভিজাত নারীর জীবনটা একদিন এলোমেলো হয়ে গেলো। একটা পর্নোসাইট থেকে কপি করে নগ্ন হয়ে স্নান করার একটা ভিডিও ওই নারীর ইনবক্সে পাঠান তার এক বন্ধু। জানতে চান—এটা কি তুমি? কীভাবে সম্ভব? মাথা ঠিক আছে তোমার? প্রথমেই ওই নারী ভাবেন আত্মহত্যা করবেন। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে তিনি বিশ্বখ্যাত পাঁচতারকা হোটেল হিল্টন ওয়ার্ল্ডওয়াইডে থেকেছিলেন। স্নান করার দৃশ্যটা সেখানকার! তিনি হিলটনের বিরুদ্ধে একশ মিলিয়ন ডলারের মানহানি ও ক্ষতিপূরণের মামলা দিয়েছিলেন। পরে প্রমাণিত হয়েছে হিলটন হোটেলের ওই শাখার দুই ব্যক্তি ওয়াশরুমে গোপন ক্যামেরা লাগিয়েছিলেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার এমন ঘটনা নিয়ে ভয়াবহ বিপদে পড়েছিল কয়েকদিন আগে। দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি বিখ্যাত হোটেলের প্রায় ১ হাজার ৬০০ অতিথি এমন গোপন ক্যামেরার শিকার হন। কারও পোশাক বদলের দৃশ্য, কারও স্নানের দৃশ্য, কারও অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন সাইটে। ভোগান্তিতে পড়া এই অতিথিদের ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করা হতো। বড় ধরনের বিক্ষোভের মুখে পড়ে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার ঘটনা তদন্ত করে কয়েকজনকে গ্রেফতার করলে পরিস্থিতির উন্নতি হয়।

২০১৫ সালে ভারতের অভিনেত্রী স্মৃতি (তখন মন্ত্রী হয়েছিলেন) ইরানি পোশাক কিনতে গিয়ে পড়েছিলেন চরম বিপদে। পোশাক বদলের জন্য ট্রায়াল রুমে গিয়ে উনি খেয়াল করেন, সেখানে ক্যামেরা বসানো আছে। এরপর স্মৃতি ইরানি পুলিশকে টেলিফোন করলে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে এবং তিনি সংবাদ শিরোনাম হন। ওই পোশাকের দোকানের সব ফুটেজ জব্দ করে পুলিশ এবং মালিক ও কর্মচারীদের গ্রেফতার করা হয়। মালিক ক্যামেরা বসানোর মূল কারণ হিসেবে যা বলেছিলেন তা শুনে চমকে গিয়েছিল পুলিশ। অনেক নারী নাকি পুরনো পোশাকের ভেতর নতুন পোশাক কৌশলে নিয়ে যেতেন! নারীদের সাজসজ্জা বিষয়ক বিখ্যাত এক প্রতিষ্ঠানে গোপন ক্যামেরা রাখা নিয়ে বাংলাদেশেও তোলপাড় হয়েছিল!

যাই হোক প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো দেশে এখন ‘ফাঁস’-এর সময় চলছে। কখন যে কী ফাঁস হয়ে যায়! সাবধান থাকুন। যখন যেখানে থাকুন, রোমান্টিকতা যতই ঘিরে ধরুক আপনাকে, আপনি চোখ কান খোলা রাখুন। আগে দেয়ালেরও কান ছিল, এখন দেয়ালেও ক্যামেরা আছে।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • শুক্রবার (সকাল ১০:১৪)
  • ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১০ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com