বিনিয়োগকারীদের এক লাখ বিও হিসাব বাতিল

বার্ষিক সার্ভিস চার্জ বা নবায়ন ফি না দেওয়ায় চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের প্রায় ১ লাখ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব বাতিল করা হয়েছে। ব্রোকারেজ হাউজগুলোর মাধ্যমে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ (সিডিবিএল) এই বিও হিসাবগুলো বাতিল করেছে। 

সিডিবিএলের তথ্য মতে, চলতি বছরের ৩০ জুন বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ১৮ লাখ ৬০ হাজার ৭৭৪টি। এক মাস পর ৩০ জুলাই সেই হিসাব ৯৩ হাজার ২২৪টি কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৬৭ হাজার ৫৫০টিতে।

বর্তমানে পুঁজিবাজারে সাড়ে ১৭ লাখ বিও হিসাব রয়েছে। এর মধ্যে একটি করেও শেয়ার নেই এমন বিও হিসাবের সংখ্যা রয়েছে ৩ লাখ ১১ হাজার ৩৩৩টি। এই বিও হিসাবগুলোও যেকোনো সময় বাতিল হতে পারে। তাতে পুঁজিবাজারে প্রকৃত বিও হিসাব সংখ্যা থাকবে প্রায় ১৪ লাখ।

সূত্র জানায়, বাতিল হওয়া এসব বিও হিসাবের মধ্যে পুরুষ বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ৬৯ হাজার ৩৫টি। গত ৩০ জুন পুরুষ বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৩৯৭টি। ৩১ জুলাই সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২২ হাজার ৩৬২টি।

একই সময়ে নারী বিনিয়োগকারী বিও হিসাব বাতিল হয়েছে ২৩ হাজার ৭৮৭টি। ৩০ জুন নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ৪ লাখ ৫২ হাজার ৫৩২টি। ৩০ জুলাই কমে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২৮ হাজার ৭৪৫টি।

এছাড়াও ৪০২টি কোম্পানির বিও হিসাব কমে ৩০ জুলাই দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৪৪৩টিতে। যা ৩০ জুন ছিল ১৬ হাজার ৮৪৫টিতে।

বিও হিসাব বন্ধ করা বিনিয়োগকারীদের একজন সালমান হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর আমার পরিবারের সদস্যদের মোট ১০টি বিও হিসাব বাতিল হয়েছে। ব্রোকার হাউজ থেকে তিন বার ফোন দিয়ে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের নবায়ন ফি দিতে বলেছে। নতুন করে বিও নবায়ন করিনি। তাই বাতিল হয়েছে।

কেন নবায়ন করেননি? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাজারে ভালো কোনো কোম্পানি আইপিওতে আসছে না। এ কারণে নতুন করে শুধু শুধু চার্জ দিয়ে লাভ নেই। তাই নবায়ন ফি জমা দেইনি।

তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) অন্যতম ব্রোকার হাউজ শাকিল রিজভী স্টক লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ডিএসইর বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেসব বিনিয়োগকারী ঝুঁকি কম নিয়ে পুঁজিবাজার থেকে মুনাফা তুলে নিতে চান, তারা মূলত প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিওতে) আসা কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু ২০২৩ সালজুড়ে উল্লেখযোগ্য কোনো কোম্পানি আইপিওতে আসেনি। ফলে আইপিওতে আবেদনকারীরা নতুন করে বিও অ্যাকাউন্ট আর নবায়ন করেননি। তাই তাদের বড় একটি অংশের বিও হিসাব বাতিল হয়েছে।

জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই কারণে এই এক লাখ বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম কারণ হচ্ছে- গত এক বছর ধরে পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস আরোপ রয়েছে। ফলে বিদায়ী বছরজুড়ে বাজার ছিল মন্দা ও অস্থিতিশীল। তাই তারা বাজার থেকে মুনাফা পাননি বিনিয়োগকারীরা।

দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে- এই সময়ে ভালো কোনো কোম্পানির আইপিও আসেনি। ফলে সেকেন্ডারি বাজার ও আইপিও বাজার থেকে কোনো ‍মুনাফা তুলতে পারেনি। নতুন করে বাজার ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না। বিনিয়োগ করেও মুনাফা তুলতে না পারায় এখন শুধু শুধু নবায়ন ফি দিয়ে বিও হিসাব সচল রাখছেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কম, এ কারণে বিনিয়োগকারীরা নবায়ন ফি জমা দেননি। তিনি বলেন, যেসব বিও বন্ধ রয়েছে বেশিরভাগই অমনিবাস বিও অ্যাকাউন্ট (ভুতুড়ে হিসাব)। বাজারের স্বার্থে অযাচিত বিও অ্যাকাউন্ট আরও কমিয়ে ফেলা উচিত। পাশাপাশি যেসব বিনিয়োগকারী আইন মানায় ব্যর্থ হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

উল্লেখ্য, নিয়ম অনুসারে প্রতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে বিনিয়োগকারীদেরকে বিও অ্যাকাউন্ট নবায়ন ফি দিতে হয়। বিনিয়োগকারীকে সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউজে এই টাকা জমা দিতে হয়। এরপর ব্রোকার হাউজগুলো দুই স্টক এক্সচেঞ্জ এবং সিডিবিএলকে নবায়ন ফি অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় বিও অ্যাকাউন্টের তালিকা পাঠায়।

প্রতি বছরের মতো চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে ব্রোকারেজ হাউজগুলো বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নবায়ন ফি নিয়েছে। এরপর সপ্তাহের শুরু থেকে সিডিবিএলকে নবায়ন ফি দেওয়ার তথ্য দিয়েছে। ব্রোকার হাউজ থেকে সিডিবিএলকে সেই তালিকা দেওয়ার শেষ সময় ছিল গত ২৭ জুলাই। এই ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে দেওয়া তথ্য মতে, দেশে ১৭ লাখ ৬৭ হাজার বিওর নবায়ন ফি পেয়েছে সিডিবিএল। ফলে এই বিওকে রেখে বাকি ১ লাখ বিও অ্যাকাউন্ট বাতিল করে দিয়েছে।

বিও হিসাব কী

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার জন্য দেশের যেকোনো একটি ব্রোকার হাউজে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) একটি হিসাবের নম্বর খুলতে হবে। এটি সাধারণত ১৬ ডিজিটের হয়। যার মাধ্যমে পুঁজিবাজারে শেয়ার কেনাবেচা করা যায়। আইপিওতে আবেদন করা যায়। ব্যক্তি, জয়েন্ট এবং কোম্পানির নামে সাধারণত বিও করা হয়।

নবায়ন ফি কত?

বছরে বিও হিসাব নবায়ন ফি ৪৫০ টাকা। কোনো বিনিয়োগকারী যদি জুলাই মাসের বিও অ্যাকাউন্ট খোলেন তবে তিনি পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত কোনো ফি ছাড়াই বিও হিসাব সচল রাখতে পারবেন। এজন্য কোনো ফি দিতে হবে না।

তবে জুলাই মাসের পর থেকে নতুন করে এক বছরের জন্য বিও অ্যাকাউন্ট সচল রাখতে ৪৫০ টাকা ফি দিতে হবে নবায়ন ফি বাবদ। এর মধ্যে সিডিবিএল ১০০ টাকা, হিসাব পরিচালনাকারী ব্রোকারেজ হাউজ ১০০ টাকা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড কমিশন (বিএসইসি) ৫০ টাকা এবং বিএসইসির মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে ২০০ টাকা জমা হয়।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com