রাতে নাকের অপারেশন, ভোরে মৃত্যু

মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান নিমতলায় বাড়ি কুয়েত প্রবাসী মো.ফাহিমের (২৫)। এক মাস আগে কুয়েত থেকে দেশে ছুটিতে আসেন তিনি। দেশে এসে লক্ষ্য করেন নাকের এক পাশের মাংস বেড়ে গেছে। নাকের চিকিৎসা করাতে মেঘনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মো. মিজানুর রহমানের শরণাপন্ন হন তিনি। চিকিৎসকের কথা অনুযায়ী নাকের অস্ত্রোপচার করাতে রাজি হয়ে যান এ কুয়েত প্রবাসী।

কিন্তু নাকের এ অস্ত্রোপচারই কাল হয়ে দাঁড়ায় ফাহিমের জীবনে। গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর বাবুবাজারে অবস্থিত মেঘনা জেনারেল হাসপাতালে নাকের অস্ত্রোপচার হয় তার। এরপর ভোরেই তিনি মারা যান।

ফাহিমের পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসার নামে ফাহিমকে হত্যা করেছেন মেঘনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মো. মিজানুর রহমান ও তার সহযোগীরা।

এ ঘটনায় শুক্রবার (১১ আগস্ট) ডিএমপির কোতোয়ালি থানায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে ডা. মো. মিজানুর রহমানসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন ফাহিমের বাবা আব্দুল সামাদ (৬৬)।

আব্দুল সামাদ এজাহারে উল্লেখ করেন, তার ছেলে মো.ফাহিম (২৯) গত ৫-৬ বছর ধরে কুয়েতে গাড়ি চালক হিসেবে চাকরি করে আসছিল। দেড় বছর আগে সে দেশে এসে বিয়ে করে আবার কুয়েত চলে যায়। সর্বশেষ ১ মাস আগে সে দেশে আসার পর লক্ষ্য করে তার নাকের মাংস বেড়ে গেছে। বিষয়টি তার নজরে আসার পর সিরাজদিখান নিমতলা বাজারে অবস্থিত জনসেবা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মো.মিজানুর রহমানকে দেখায়। ফাহিমের নাকের সমস্যা দেখার পর ডা. মিজানুর রহমান বলেন, তার নাকে অপারেশন করাতে হবে। এ জন্য ফাহিমকে রাজধানীর বাবুবাজারে অবস্থিত মেঘনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ফাহিম তার খালাতো ভাই মো. শহিদুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে গত বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) সন্ধ্যা ৭টায় মেঘনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়। ওই দিন রাত ১২টার দিকে ডা. মো.মিজানুর রহমান হাসপাতালে আসেন এবং রাতেই অস্ত্রোপচার হবে বলে জানান। পরে রাত ২টার দিকে ফাহিমকে হাসপাতালের ৬ষ্ঠ তলায় অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় অস্ত্রোপচারের জন্য।

এজাহারে আরও বলা হয়, ভোর ৪টায় শহিদুল ইসলামকে ডা. মিজানুর জানান ফাহিমের অবস্থা খুবই খারাপ তাকে দ্রুত আইসিইউতে নিতে হবে। তখন ডা. মিজানুরসহ হাসপাতালের অন্য কর্মচারীদের সহায়তায় তড়িঘড়ি করে অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে ধোলাইখালের ডেল্টা হাসপাতালে পাঠানো হয়। ডেল্টা হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। এরপর ভোর ৫টার দিকে আবার মেঘনা জেনারেল হাসপাতালে ফাহিমের মরদেহ নিয়ে আসে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসলে ডা. মো.মিজানুর রহমানসহ তার সহযোগীরা পালিয়ে যায়। পরে সকাল ১০টার দিকে ফাহিমের মরদেহ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়।

ফাহিমের বাবার অভিযোগ, তার ছেলেকে চিকিৎসার নামে ডা. মো. মিজানুর রহমান ও মেঘনা জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হত্যা করেছে।

এ বিষয়ে ফাহিমের খালু মো. সোহরাব ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফাহিমের সামান্য একটু নাকের মাংস বেড়ে গিয়েছিল। সিরাজদিখান নিমতলা বাজারে প্রতি বৃহস্পতিবার চেম্বারে ডা. মো. মিজানুর রহমান রোগী দেখতেন। আশেপাশের নামডাক থাকায় ফাহিম তার কাছে যায়। তখন ডাক্তার ফাহিমকে নাকের অপারেশনের কথা বলেন। যেহেতু সে কাতার প্রবাসী সে আবারও সেখানে চলে যাবে, তাই যাওয়ার আগে অপারেশন করে এ সমস্যাটা সমাধান করতে চেয়েছিল। কিন্তু সামান্য নাকের অপারেশন করাতে গিয়ে ফাহিমের এভাবে অকাল মৃত্যু হলো।

তিনি বলেন, ফাহিমের হার্টের সমস্যা কিংবা উচ্চ রক্তচাপসহ কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যা ছিল না। জলজ্যান্ত একটা ছেলেকে এভাবে চিকিৎসার নামে হত্যা করা হলো! সবাই পশু হয়ে গেছে, না হলে সামান্য একটি অপারেশন করাতে গিয়ে এভাবে একটি ছেলে মারা যায়?

তিনি বলেন, ফাহিমের উপর তার পুরো পরিবার নির্ভরশীল। ফাহিমের বাবা-মার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ফাহিমের বোন তার বড়। ফাহিমের বাবা দীর্ঘদিন কুয়েত প্রবাসী ছিলেন। উনি দেশে চলে আসার পর, ফাহিম পরিবারের হাল ধরতে কুয়েতে যায়। সে-ই এখন সংসারটি চালাত। মাত্র দেড় বছর আগে ছেলেটা বিয়ে করেছে, তার স্ত্রীও সন্তানসম্ভবা।

তিনি বলেন, ঘটনার দিন হাসপাতালে গিয়ে দেখি পুরো হাসপাতাল ফাঁকা। কেউ নেই দুই একজন দারোয়ান ছাড়া। ফাহিমের মৃত্যুর পর সবাই পালিয়ে গেছে। ভেতরে গিয়ে দেখি রেজিস্টার খাতা থেকে ফাহিমের নামটি কাটার চেষ্টা করা হয়েছে। পরে আমরা একটি স্লিপ পাই যেখানে ফাহিমের ভর্তির তথ্য রয়েছে। আমাদের প্রাথমিক ধারণা, মেয়াদোত্তীর্ণ অ্যানেস্থেসিয়া ব্যবহারের কারণে ফাহিমের অকাল মৃত্যু হয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য মেঘনা জেনারেল হাসপাতাল লি. এর একাধিক ফোন নম্বরে কল করেও কাউকে পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে ডিএমপির কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাহিনুর ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযুক্ত আসামিরা সবাই পলাতক। তাদের গ্রেপ্তারে আমরা অভিযান চালাচ্ছি। আমরা অভিযোগ পেয়েছি, ফাহিম হাসপাতালটিতে গিয়েছিলেন নাকের অপারেশন করার জন্য। এরপর সেখানে তার অবস্থার অবনতি হয়। পরে তাকে অন্য হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

পুরানো সংবাদ
সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com