২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। দেশের ইতিহাসে স্মরণকালের নৃশংসতম গ্রেনেড হামলা ঘটেছিল সেদিন। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য দিচ্ছিলেন। বক্তব্যের প্রায় শেষ পর্যায়ে প্রচণ্ড শব্দে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। চোখের পলকে জলজ্যান্ত অসংখ্য মানুষের শরীর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ঘটনায় নিহত হন আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী। আহত হন কয়েক শতাধিক মানুষ। এখনো অনেকে সেই গ্রেনেডের স্প্লিনটার শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন।
ভয়াল গ্রেনেড হামলার কথা মনে হলে সবচেয়ে বেশি চোখে ভাসে রক্তাক্ত আইভি রহমানের একটি ছবি। ছবিটিতে আরেকজনকে দেখা যায়, যিনি আইভি রহমানকে নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আছেন। আইভী রহমানকে ধরে আহাজারি করা মানুষটি হচ্ছেন আবুল কাশেম। ২১ আগস্ট মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এ প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকা পোস্টের কাছে বর্ণনা করেছেন সেই ভয়াল দিনের স্মৃতি।গ্রেনেড হামলার সময় আবুল কাশেম ছিলেন ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহসভাপতি। এখন তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। থাকেন গুলশানের শাহজাদপুরে। তার বাড়ি লক্ষ্মীপুরের গঙ্গাপুর গ্রামে।আবুল কাশেম বলেন, ‘সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে শেখ হাসিনাকে নূর হোসেন চত্বর থেকে রিসিভ করে ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে নিয়ে যাই। ২৩ আগস্ট ছাত্রলীগের একটি অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। সেই অনুষ্ঠানে দাওয়াতের কার্ডগুলো আমার কাছে ছিল। আমার উদ্দেশ্য ছিল নেতাদের দাওয়াতের কার্ডগুলো বিতরণ করা। নেত্রী যখন জনসভায় আসেন তখন বিকেল আনুমানিক সাড়ে ৩টা। প্রচণ্ড গরম। মানুষের অনেক ভিড়। মনোযোগ সহকারে নেত্রীর ভাষণ শুনছে জনতা। এমন সময় হঠাৎ বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। একের পর এক বিস্ফোরণ। মানুষ দিগ্বিদিক হয়ে চারদিকে ছুটতে শুরু করে। দিশেহারা মানুষের দৌঁড়াদৌড়ির ভিড়ে আমি মাটিতে পড়ে যাই। আমাকে ডিঙিয়ে হাজার হাজার মানুষ একের পর এক ছুটে যাচ্ছে। আমি ওঠার সুযোগ পাচ্ছি না। কী ঘটছে, কোথায় আছি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।’তিনি বলেন, ‘একসময় লক্ষ্য করলাম আমি জয় মার্কেটের কলাপসিবল গেটের কাছে পড়ে আছি। চোখ তুলে দেখি নেত্রীকে ব্যারিকেড দিয়ে দলের নেতাকর্মীরা গাড়িতে ঢুকাচ্ছে। শরীরে ব্যথা। কোনোমতে নিজেকে টেনে তুললাম। সাংবাদিক শাহেদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নেত্রীর কী অবস্থা’? তিনি বলেন, ‘নেত্রী আছেন।’ নেত্রী চলে যাওয়ার পর পার্টি অফিসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সুরঞ্জিত দা, হানিফ ভাই রক্তাক্ত অবস্থায় বের হচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর সাহেরা খাতুনকে বের হতে দেখি। তাকে স্টেডিয়ামের কর্নারে তার গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিলাম।’‘সাহেরা খাতুনকে রেখে আসতে মিনিট ১৫ সময় লাগে। এসে দেখলাম আইভি চাচী (আইভি রহমান) ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে রাস্তায় শুয়ে আছেন। এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ছে পুলিশ। অনেক আহত এবং ডেড বডিগুলোতে পুলিশ লাথি মারছে। উনাকে (আইভি রহমান) তুললাম। আমি বোঝার চেষ্টা করছি উনি বেঁচে আছেন কি-না। তাকে তো ইমার্জেন্সি হাসপাতালে নেওয়া দরকার। কিন্তু আশপাশে কোনো গাড়ি নেই, রিকশা নেই, ভ্যান নেই, কিছু নেই। তাকে তুলে দেব কোথায়? ধরেই রাখলাম। কিছুক্ষণ পরে লিটন আসলেন। লিটন আইভি চাচীর ফ্যামিলি মেম্বার। দুইজনে তাকে ধরে রাখলাম। এ সময় নেত্রীর গাড়ির ড্রাইভার আলী হোসেন (শহীদ নূর হোসেনের ভাই) একটা গাড়ি নিয়ে আসলেন। তাকে বললাম, ভাই আইভী চাচী এখানে পড়ে আছেন। এখনই হাসপাতালে নিতে হবে। ধরাধরি করে আইভি চাচীকে দ্রুত গাড়িতে তুলে দিলাম। আমার সাথে লিটন, রবিউল হোসেন কচি ছিল। তখন উদ্ধারকর্মী কেউ ছিল না। সারা মাঠে খণ্ডিত মরদেহ। বিচ্ছিন্ন হাত, পা, বুক। রক্তমাখা জুতা, স্যান্ডেল, শার্ট আর পতাকা। যেন মৃত্যু উপত্যকায় আমি দাঁড়িয়ে আছি।’আবুল কাশেম বলেন, ‘প্রিয় মানুষের আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনায় হতবিহবল হয়ে পড়েছিলাম। আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সও খুঁজে পাওয়া যায়নি। যে কারণে রিকশা-ভ্যানে, এমনকি ঠেলাগাড়িতে করে আহতদের নেওয়া হয় বিভিন্ন হাসপাতালে। আহতদের উদ্ধারে পুলিশের কোনো তৎপরতা ছিল না। উল্টো কর্তব্যরত পুলিশ বাহিনী বেধড়ক লাঠিচার্জ ও অবিরাম টিয়ার শেল ছুড়েছিল।’আবুল কাশেম বলেন, ‘আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না বেঁচে আছি। দীর্ঘ দিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়েছি। কিন্তু বীভৎস সেই হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি এখনো মনে চেপে আছে। সেই স্মৃতি স্বপ্নে এসে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেয়। আমাদের সাথে ছাত্র রাজনীতি করতেন সেন্টু ভাই। ২১ আগস্টে তিনিও শহীদ হন। তার খণ্ডিত দেহ আমাকে অস্থির করে তোলে। ঘৃণায় থুথু জমা হয় খুনিদের জন্য।’
২১ আগস্ট শেখ হাসিনা যখন ভাষণ দিচ্ছেন তখন তাঁর গাড়ির পাশে ছিলেন আবুল কাশেম। হাতে ছিল নগর ছাত্রলীগ আয়োজিত শোক দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানের কার্ড। নেত্রীর ভাষণ শেষে থানা কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যদের মধ্যে কার্ডগুলো বিতরণের কথা ছিল।
আবুল কাশেম বলেন, ‘কিন্তু তখন কে জানত আরও একটা শোকের সাক্ষী হতে আমার দাঁড়িয়ে থাকা?’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় যেভাবে বিএনপি-জামায়াতের নির্যাতনের শিকার হয়েছি, তারা আমাদের দলের নেতাকর্মীদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, গ্রেনেড মেরেছে, হাজার হাজার মায়ের বুক খালি করেছে, শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ করার অপরাধে অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে, ধর্ষণ করেছে সেই বিএনপির রাজপথে মিছিল-মিটিং দেখে আতঙ্কিত হই। ২১ আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আদালতের রায়ে দণ্ডিত আসামিদের দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি। আমার একটাই চাওয়া, শেখ হাসিনা বেঁচে থাকুক, আমাদের মাথার ছায়া হয়ে থাকুক।’