মায়ের জন্যই ক্যারিয়ারে ভালো কিছু করতে চাইতাম

মো. সোপান তালুকদার। শৈশব কেটেছে টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। শিক্ষাজীবনের শুরুও সেখানে। উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে। শিক্ষক বাবার আদর্শ আর মায়ের অনুপ্রেরণায় জায়গা করে নিয়েছেন ৪১তম বিসিএসের সেরাদের তালিকায়। ১১তম মেধাক্রম নিয়ে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন পররাষ্ট্র ক্যাডারে।

সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। উন্মোচন করেছেন জীবনের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া সফলতা ও ব্যর্থতার বিচিত্র অধ্যায়। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক।

ঢাকা পোস্ট : আপনার নিজের সম্পর্কে কী বলে শুরু করতে চান?

সোপান তালুকদার : আমি অন্তর্মুখী মানুষ। পরিচিতদের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি বেশি। তবে বিভিন্ন জায়গায় পড়াশোনা করার কারণে অনেক মানুষের সঙ্গে মিশতে হয়েছে। সেদিক বিবেচনায় মিশুকও বলতে পারেন।

ঢাকা পোস্ট : আপনার ছোটবেলার গল্প শুনতে চাই। বেড়ে ওঠা এবং শৈশবের স্মৃতি নিয়ে জানতে চাই।

সোপান তালুকদার : আমার ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে। বাবা ছিলেন আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। আমার প্রাইমারি এডুকেশন আমার গ্রামের স্কুলেই হয়েছে। আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র, তখন আমার বাবা মারা যান। আমার শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করতে আমার পরিবারের সবাই অনেক ভূমিকা রেখেছেন। বাবা মারা গেলেও একটি স্বপ্ন তিনি ছেলেবেলাতেই এঁকে দিয়েছিলেন। তার আদর্শই পরবর্তীতে চলার পথের রসদ জুগিয়েছে।

ঢাকা পোস্ট : চাকরির ক্ষেত্র তো আরও আছে, বিসিএসকেই কেন বেছে নিলেন?

সোপান তালুকদার : আসলে আমার ক্যারিয়ারের লক্ষ্য ছিল দুটি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া অথবা বিসিএস ক্যাডার হওয়া। অনার্সে যখন অল্পের জন্য সিজিপিএ ৩.৫০ পেলাম না তখন ক্যারিয়ার হিসেবে বিসিএসের মাধ্যমে প্রাপ্ত কোনো ক্যাডার পদকে লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিলাম।

ঢাকা পোস্ট : পররাষ্ট্র ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। বিষয়টি জানার পর কেমন অনুভূতি ছিল?

সোপান তালুকদার : অনুভূতিটা অবশ্যই স্পেশাল। তবে এটাও মনে রাখি, দিন শেষে এটা শুধু একটা চাকরিই হবে।

ঢাকা পোস্ট : পররাষ্ট্র ক্যাডার পছন্দ?

সোপান তালুকদার : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আমার ছোটবেলা থেকে অনেক আগ্রহ ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। সেই আগ্রহ থেকেই পররাষ্ট্র ক্যাডার পছন্দক্রমের প্রথমে রাখা।

ঢাকা পোস্ট : কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?

সোপান তালুকদার : প্রিলিমিনারির প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার লিখিত সিলেবাসের যে অংশগুলো মিল আছে, সেই অংশগুলোও পড়ে ফেলতাম। যেটা আমার লিখিত প্রস্তুতিকে অনেক সহজ করে দিয়েছিল। আর তথ্যগুলো নোট করে রাখতাম যেন পরীক্ষার আগে সহজেই চোখ বুলিয়ে নেওয়া যায়।

ঢাকা পোস্ট : বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিসিএস নিয়ে ব্যাপক উদ্দীপনা দেখা যায়। এমনকি কেউ কেউ বিসিএসকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য মনে করেন। এমনটা কি হওয়া উচিত?

সোপান তালুকদার : এমনটা আসলে হওয়া উচিত না। তবে বর্তমান বাস্তবতায় কারো সামাজিক অবস্থান বিসিএসের মাধ্যমে খুব দ্রুত পরিবর্তন করা যায়। তাই সবাই বিসিএসমুখী হতে চায়। তবে বিসিএসের বিকল্পগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। তবেই আমাদের পেশা বহুমুখী হবে।

ঢাকা পোস্ট : আপনার সফলতার পেছনে নিশ্চয়ই ব্যর্থতার গল্পও লুকিয়ে আছে। এমন কিছু ব্যর্থতার গল্প শুনতে চাই।

সোপান তালুকদার : আমি এখন পর্যন্ত ৯টা ভাইভা দিয়েছি। সেখান থেকে ৪টা ভাইভাতে জব পেয়েছি। বাকিগুলোতে ব্যর্থ। আমার প্রথম জব পেতেই তিন বছরের মতো লেগেছিল। তাই আমি মনে করি, ব্যর্থতা না থাকলে সফলতা ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায় না। আসলে জীবনের বাঁকে বাঁকে ব্যর্থতায় মোড়ানো অনেক গল্প থাকে। কত মানুষ হাল ছেড়ে দেন। কেউবা আবার হাঁটুর ওপর তাল ঠুকে, দু আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে উড়িয়ে দিতে চান পাওয়া না পাওয়ার হিসাবনিকাশ। আমাদের চারপাশে তো এমন কত কিছুই ঘটে। তার সবকিছু কি আমরা জানি? থাকুক না কিছু অজানা বিষাদ।

ঢাকা পোস্ট : বিসিএস দিতে যারা আগ্রহী, তাদের জন্য কি পরামর্শ থাকবে?

সোপান তালুকদার : তাদের জন্য আমার পরামর্শ থাকবে, সবাই বিসিএস দিচ্ছে, তাই আমার বিসিএস দিতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। যদি সত্যিই বিসিএস দেওয়ার উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে তাকে সেই পরিমাণ ধৈর্য ও পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে এবং পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকতে হবে। আপনি যেটাই হতে চান না, সেটা আগে সুনির্দিষ্ট করে সেই উদ্দেশ্যে আন্তরিকতার সঙ্গে পরিশ্রম করে যান। মনে রাখতে হবে, আপনার জন্য যা মঙ্গল, সৃষ্টিকর্তা সেটাই আপনাকে দেবেন। কিন্তু প্রস্তুতিতে কোনো অবহেলা করা যাবে না। আপনার সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে দৈনিক পরিকল্পনা করুন। প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন শেষ করুন। পরিমিত চেষ্টা করুন আর ভরসা রাখুন আপনার প্রতিপালকের ওপর।

ঢাকা পোস্ট : ভাইভার প্রস্তুতি কেমন হতে হয়?

সোপান তালুকদার : আমি ভাইভার প্রস্তুতি নিতে যেটা করেছিলাম, যারা ভাইভা প্রার্থী ছিল তাদের সঙ্গে নিয়মিত মক ভাইভা দিতাম। এটা আমার কনফিডেন্স বাড়াতে সহায়তা করেছিল এবং ভাইভার ছোট ছোট ম্যানার, এটিকেট ঠিক করতে সহায়তা করেছিল।

ঢাকা পোস্ট : পর্দার আড়ালে থেকে কেউ কি অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে গেছেন? কার কথা বেশি মনে পড়ে?

সোপান তালুকদার : অনেক ছোট থাকতে বাবা মারা যাওয়ায় আমাকে বড় করতে মাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমার মায়ের জন্যই আমি ক্যারিয়ারে ভালো কিছু করতে চাইতাম। এছাড়া আমার বড় বোন, আমার দুই চাচা ও তিন মামা– সবাই অনেক সাপোর্ট করেছেন। আমার মামাতো ভাই আছেন, যিনি অ্যাডিশনাল এসপি হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি বিসিএস প্রিপারেশনের ব্যাপারে অনেক হেল্প করেছেন। আমার স্ত্রীও আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। সবার প্রতিই আমি কৃতজ্ঞ। জীবন ভালো ও খারাপ সময়ের সমষ্টি। খারাপ সময় এলে ধৈর্য ধরে মোকাবিলা করাটাই মূল চ্যালেঞ্জ। সবার মতো আমারও অনেক খারাপ সময় ছিল। আমি চেষ্টা করেছি, যতটুকু পারা যায় মোকাবিলা করতে। সব সময় সফল হইনি, আবার সব সময় বিফলও হইনি। এই মানুষগুলোই আমার বেঁচে থাকা কিংবা এগিয়ে চলার সাহস-অনুপ্রেরণা। তারা না থাকলে আজকের এই আমি হয়ে ওঠার গল্পটা আরও কঠিন হয়ে যেত।

ঢাকা পোস্ট : পররাষ্ট্র ক্যাডারে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?

সোপান তালুকদার : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে পদেই থাকি না কেন, আমি যেন দেশের জন্য নিজের সর্বোচ্চটা দিতে পারি, একইসঙ্গে নিজে সৎ থাকতে পারি, সেটাই আমার প্রত্যাশা।

ঢাকা পোস্ট : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সোপান তালুকদার : আপনাকেও ধন্যবাদ। ঢাকা পোস্টের জন্য শুভ কামনা

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com