অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসের কারণে দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে স্ট্রোক। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মতান্ত্রিক চলাফেরায় ৯০ শতাংশ স্ট্রোকই প্রতিরোধযোগ্য। এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে এবং গরিব-অসহায়দের বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দিতে ‘ফ্রি স্ট্রোক ক্লিনিক’ নামে একটি সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে রাজধানীর উত্তরায়।
বর্তমানে উত্তরার হাই-কেয়ার নিউরো স্পেশালাইজড হাসপাতালে এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে বৃহৎ আকারে সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে উদ্যোক্তাদের। জনমানুষের সেবায় এই চিকিৎসা কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শফিকুল ইসলাম।
জানা গেছে, আপাতত প্রতি মাসে তিনদিন এই সেবা কার্যক্রমটি পরিচালিত হচ্ছে। রোস্টারের ভিত্তিতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে ছয় থেকে আটজন চিকিৎসক নিয়মিত এই ফ্রি স্ট্রোক ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা দেন। এ কার্যক্রমে যেসব চিকিৎসক চিকিৎসা ও পরামর্শ দেন, তারা রোগীদের থেকে কোনো ফি নেন না। তাছাড়া যে হাসপাতালে এ কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়, তাদের পক্ষ থেকেও রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়।
দূরদূরান্ত থেকে আসছেন রোগীরা, সেবা নিয়ে ফিরছেন হাসিমুখে
ফ্রি স্ট্রোক ক্লিনিকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার খবরে সেবা নিতে আসা মো. এমদাদুল হকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফ্রি স্ট্রোক ক্লিনিকের কাউন্সেলিংয়ে এসে আমি অনেক কিছুই জেনেছি। এ বিষয়ে না জানার কারণে আমরা অনেক সময়ই বিপদে পড়ি। অনেকগুলো বিষয় আছে, সেগুলো যদি আমরা আগেই জানতে পারি, তাহলে সচেতন হওয়ার সুযোগ থাকে এবং একটা বড় বিপদ থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি।
মাসের যে দিন যে সেবা মেলে ফ্রি স্ট্রোক ক্লিনিকে
ফ্রি স্ট্রোক ক্লিনিকের অন্যতম উদ্যোক্তা মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ব্যক্তিগত জীবনে আমরা প্রত্যেকেই নানা কাজে ব্যস্ত থাকি। কিন্তু এর মধ্যেও প্রতি মাসের নির্দিষ্ট তিনটি দিন আমরা ফ্রি স্ট্রোক ক্লিনিকের মাধ্যমে একত্রিত হই এবং সাধারণ মানুষকে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। মাসে তিনদিনের মধ্যে একটি মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার, অপরটি মাসের শেষ শুক্রবার এবং অন্যটি হলো মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার।
তিনি বলেন, মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবারে রাজধানীসহ সারা দেশ থেকে আসা রোগীদের স্ট্রোক নিয়ে বিশেষ কাউন্সেলিং, সচেতনতা ও বিনামূল্যে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। এছাড়া মাসের শেষ শুক্রবার দিনব্যাপী শুধু স্ট্রোকের রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। ওই দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চার থেকে পাঁচজন চিকিৎসক রোগী দেখেন। শতাধিক স্ট্রোকের রোগী দিনটিতে এসে ফ্রি স্ট্রোক ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা নেন।
মুজিবুর রহমান বলেন, প্রতি মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার শুধু কোমর ব্যথা নিয়ে আসা রোগীদের পিএলআইডি (প্রল্যাপসড লাম্বার ইন্টারভার্টিব্রাল ডিস্ক) বা ডিস্ক হার্নিয়েশনের অপারেশন করা হয়। দিনটিতে অন্তত চার থেকে ছয়জন রোগী সরকারি হাসপাতালের খরচে এ ক্লিনিকে এসে অপারেশন করাতে পারেন। সাধারণত একটি বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশনটি করাতে খরচ হয় দেড় থেকে দুই লাখের মতো। কিন্তু আমরা কিছু ওষুধপত্রসহ খরচ বাবদ ৪০ হাজার টাকার মতো রোগীদের থেকে নিই, যা সাধারণত একটি সরকারি হাসপাতালে অপারেশনের ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক খরচ হয়ে থাকে।
‘অনন্য’ এই কার্যক্রমে যুক্ত আছেন যারা
জানা গেছে, জনসেবামূলক এ ‘ফ্রি স্ট্রোক ক্লিনিক’ কার্যক্রম পরিচালিত হয় ন্যাশনাল স্ট্রোক ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ (এনএসটিবি) নামের একটি ট্রাস্টের সার্বিক সহযোগিতায়। সাত সদস্যের এই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শফিকুল ইসলাম।
ট্রাস্টের অন্য সদস্যরা হলেন– ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুহতাসিমুল হাসান শিবলু, সহকারী অধ্যাপক ডা. সুমন রানা, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রবিউল করিম, উত্তরা আধুনিক হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. আহসান মোহাম্মদ হাফিজ। এছাড়াও রয়েছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. মজিবুর রহমান এবং আকাশ আহমেদ।
‘ফ্রি স্ট্রোক ক্লিনিক’ কার্যক্রম শুরুর গল্প
ফ্রি স্ট্রোক ক্লিনিক কার্যক্রমের প্রধান উদ্যোক্তা অধ্যাপক ডা. শফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন নিউরোসার্জন হিসেবে আমি মনে করি, আমার কাজ হলো চিকিৎসার পাশাপাশি মানুষের মধ্যে রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা। আমরা জানি স্ট্রোক প্রতিরোধে প্রধান করণীয়ই হলো সচেতনতা। এ কাজটি এককভাবেও করা যায়, তবে একটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে হলে কাজটি বড় পরিসরে করা যায়। সেই চিন্তা থেকেই আমাদের ফ্রি স্ট্রোক ক্লিনিকের যাত্রা শুরু হয়।
তিনি বলেন, আমাদের প্রথমত কাজ হলো মানুষের মধ্যে স্ট্রোক নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা। কেউ যদি আমাদের একটি কাউন্সেলিংয়ে অংশগ্রহণ করেন, তিনি আমাদের এ কার্যক্রমের একটি অংশ হয়ে যান। তারপর তারাও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরির কাজটি করেন। আমাদের এ কার্যক্রমে আরও কয়েকজন চিকিৎসক আছেন, চিকিৎসা পেশার বাইরেরও কিছু মানবিক মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন। আমি সব সময় এ ধরনের ভালো কাজগুলোর সঙ্গে থাকতে চাই।
‘স্ট্রোকের জন্য শুধু ডাক্তার দেখানো আর কিছু ওষুধ নিয়ে বাসায় ফেরাই মূল চিকিৎসা নয়, লাইফস্টাইল সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়াটা মূল বিষয়। একজন যদি জানেন যে, এই কাজগুলো করলে স্ট্রোক হয় এবং এই কাজগুলো করলে স্ট্রোক থেকে মুক্ত থাকা যায়, তাহলে অধিকাংশ মানুষই সচেতনতার মাধ্যমে স্ট্রোক থেকে মুক্ত থাকবেন।’
বিশিষ্ট এই নিউরোসার্জন বলেন, সচেতনতার বাইরেও আমরা দিনব্যাপী বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে আমরা হাই-কেয়ার নিউরো স্পেশালাইজড হাসপাতালের সহযোগিতা পাচ্ছি। তারা শুধু জায়গা দিয়েই নয়, রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়ও সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। তাছাড়া তারা কমিটমেন্ট দিয়েছেন যে, আমাদের এখানে আসা স্ট্রোকের রোগীদের তারা হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে চিকিৎসায় অগ্রাধিকারসহ অর্থনৈতিকভাবেও বিশেষ বিবেচনা করবেন। আমি স্বপ্ন দেখি, আমাদের এ কার্যক্রমটি অনেক দূর এগিয়ে যাবে।