‘একবার আমার খালা ভারত থেকে ঈদের সময় আমাদের বাড়িতে আসেন। তিনি আমার মাকে বলেন, আমাকে ভারতে নিয়ে গিয়ে একটা চাকরি দেবেন, আমাদের সংসারে আর অভাব থাকবে না। কিন্তু আমাকে সেখানে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। প্রতিদিন দশ জন লোক আমার দেহ আঁচড়ে খেয়েছে।’
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা বিবিসিকে এসব কথা বলছিল বাংলাদেশ থেকে ভারতের গুজরাটে পাচারের শিকার অপ্রাপ্তবয়স্ক এক মেয়ে।
কাজ ও উপার্জনের আশায় অবৈধ পথে মেয়েটি ভারতে পৌঁছেছিল। সম্প্রতি তাকে গুজরাট থেকে আবার বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে তার পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। এর পরিবর্তে ছদ্মনাম হিসেবে এখানে ‘সালমা’ নাম ব্যবহার করা হচ্ছে।
সালমার সাথে কথা বলার সময় বোঝা যাচ্ছিল, অনেক কম বয়সে খুব তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।
বাংলাদেশে ফেরার আগে সালমা দু’বছর ছিল গুজরাটের জাগরুত মহিলা সংস্থা নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে। তারা তাকে চিকিৎসা ও কাউন্সেলিং সেবা দিয়ে নতুন করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। তারাই সালমাকে বাংলাদেশে তার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে।সালমা গুজরাট ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরেছে। কিন্তু এই বয়সেই যে শারীরিক ও মানসিক ক্ষত তৈরি হয়েছে, সেটি হয়তো তার বাকি গোটা জীবনেও পূরণ হওয়ার নয়। ঘরে ফিরে যাওয়ার আগে যে গল্প সে বিবিসি গুজরাটিকে বলেছে, তা ছিল খুবই হৃদয়বিদারক।
• খালা বলেছিলেন, ভারতে গেলে আমি চাকরি পাবো
জাগরুত মহিলা সংস্থার প্রেসিডেন্ট আশাভান দালাল জানান, পুলিশ প্রায় আড়াই বছর আগে সালমাকে তার অফিসে নিয়ে আসে। পুলিশ সালমাকে স্থানীয় একটি বাসস্ট্যান্ডের কাছে খুবই বিচলিত অবস্থায় দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে।
আশাভান বলেন, সে যখন আমার অফিসে আসে, তখন সে চুপচাপ হয়ে একটা কোণে বসে থাকত। আমরা চিকিৎসা দিই। ধীরে ধীরে সে কথা বলতে শুরু করে। সে যখন নিজের সম্পর্কে বলা শুরু করল তখন আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
সালমার গল্প শুরু হয় বাংলাদেশে। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করার কারণে ভারতে নিয়ে এসে সালমাকে তার এক আত্মীয় পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করে, যাকে সে খালা বলে ডাকত।
সালমা বলে, ‘আমার খালা ঈদে আমাদের বাড়িতে এসে আমার মাকে অনেক কিছু উপহার দেয়। আমি আর আমার মা খুব খুশি ছিলাম। তিনি আমার মাকে বলেন, আমি যদি তার সাথে ভারতে যাই, তাহলে সেখানে আমি চাকরি পাব।’
‘খালা তখন বলেছিল, ভারতে তিনিও অনেক টাকা আয় করেন। তিনি আমার মাকে বলেছিলেন, এখানে মানুষ অন্যের বাসায় কাজ করেও অনেক টাকা আয় করতে পারেন। আমরা মনে করেছিলাম, চাকরি পেলে আমাদের অভাব দূর হবে। আর আমরা সেটাই করলাম।’
তখন সালমার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। তার খালা তাকে অবৈধভাবে ভারতে নিয়ে যান। সালমা বলে, ভারতে প্রবেশ করার সাথে সাথে তার খালার আচরণ বদলে যায়।
সালমাকে ‘বিক্রি’ করে দেন খালা
সালমা বলে, ভারতে পৌঁছানোর পর তার খালা বলেন, ‘তোমার পাসপোর্ট নেই। তুমি এখানে অবৈধভাবে এসেছ। আমি যেখানে কাজ দেবো, তোমাকে সেখানেই যেতে হবে, তা না হলে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরবে।’
সালমা হিন্দি জানত না। কিন্তু সে বুঝতে পেরেছিল যে, সে সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে। সালমা বলে, একদিন আমার খালা আমাকে একটি হোটেলে নিয়ে যান। সেখানে তিনি আমাকে একজন লোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি জানি না তাদের মধ্যে কী কথা হয়।
কিন্তু খালা বলেন, ভারতে থাকতে হলে তাকে আমার টাকা দিতে হবে। সালমা তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, সে কীভাবে তার মায়ের কাছে টাকা পাঠাবে যদি সে বেতন না পায়।
• অনেক সময় ১৮ জন পুরুষের সাথে রাত্রীযাপন করতে হতো
সেখান থেকেই সালমার সমস্যার শুরু। সে খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারে যে তাকে বিক্রি করা হয়েছে। এরপর প্রতি রাতেই হতো তার নিজের বিকিকিনি।
সেই সব ভয়ংকর দিনের কথা মনে করে সালমা বলে, প্রতি রাতে তারা আমার দেহ আঁচড়ে খেয়েছে। অনেক সময় আমাকে ১০ জনের সাথে শুতে হতো, কখনো কখনো ১৮ জনের সাথেও থাকতে হয়েছে। এর বিনিময়ে আমি যা পেয়েছি তা হলো খাবার আর ঘুমানোর জায়গা। অনেক সময় খদ্দেররা বকশিস দিতো, আর সেটাই ছিল আমার একমাত্র উপার্জন।
সে বলে, নিয়োগকর্তা আমাকে বলত যে, সে আমার টাকা আমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু পরে সালমা জানতে পারে, তার মা কোনো টাকা পাননি। দেহ ব্যবসাটা অনেক সময় ফাঁদের মতো। সে সেখান থেকে পালাতে চাইত, আবার পুলিশের কাছে ধরা পড়ারও ভয় ছিল। কিন্তু একদিন সালমা যে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিল সেটি পেয়ে যায়।