একবেলা না খেয়ে থাকতে পারলেও মোবাইল ছাড়া এক মিনিটও না

‘যখনই খাবারের সময় হবে বাচ্চারা টিভি দেখতে দেখতে সেটা খাবে। টিভি বন্ধ করে দিলাম তো ফোন দেখতে থাকবে। ফোনটা নিয়ে নিলাম তো আবার টিভি। ওরা ফোন বা টিভি ছাড়া থাকতেই পারছে না।’

শিশু-কিশোরদের স্মার্টফোন আসক্তি, আরও বিশদে বলতে গেলে স্ক্রিন আসক্তি নিয়ে অভিভাবকদের কীভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেই কথাই বলছিলেন কক্সবাজার শহরের কলাতলী চন্দীমা এলাকার বাসিন্দা সেকুফা সুলতানা। তার মেয়ের বয়স ১২, ছেলের চলছে ৬। মেয়ের ফোন না থাকলেও ছেলে মায়ের ফোন নিয়েই মগ্ন থাকে দিনের বড় একটা সময়, হয় কোনো গেইমে, নয়তো ইউটিউবে।

ঢাকা পোস্টকে সেকুফা সুলতানা বলেন, মোবাইল গেম ও কার্টুনে ছেলে-মেয়েরা আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে এখন আর খেলাধুলায় অভ্যস্ত না হয়ে বাড়িতে, বাগানে ও মাঠে-ঘাটে অর্থাৎ বিভিন্ন জায়গায় মোবাইলের মাধ্যমে গেম খেলাসহ নানা ধরনের আসক্তিমূলক সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। পড়াশোনায় আগ্রহ কমেছে। ছোট ছেলে মোহাম্মদকে খাওয়ানোর সময় মোবাইল না দিলে সে খেতে চাই না। মেয়ে আলভিয়া স্কুল থেকে এসে রেস্ট ও খাওয়া-দাওয়া না করে টেলিভিশনে কার্টুন দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এটা নিয়ে আমি খুব চিন্তিত। এটা থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাব বুঝতে পারছি না।

সেকুফা সুলতানার মতো ছেলে-মেয়ের মোবাইল আসক্তি নিয়ে একই সমস্যায় ভুগছেন শহরের বাসিন্দা তামান্না বেগম। তার মেয়ে আয়েশা কক্সবাজার কেজি মডেল হাই স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। ছোটকাল থেকে মোবাইলে ভিডিও ও গেমস আসক্ত। সামনে তার এসএসসি পরীক্ষা হলেও পড়াশোনার প্রতি তেমন আগ্রহ নেই। মেয়ে আয়েশা অনলাইনে ক্লাস করার নামে সমাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সময় ব্যয় করে। এত পরিমাণ সে মোবাইল ও সমাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত যার কারণে চোখে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলে তার চশমা ব্যবহার করতে হচ্ছে। এটা নিয়ে তাকে বেশ কয়েকবার মারধর করা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল বিপরীত।

সম্প্রতি কক্সবাজার শহরে আন্তঃভারুয়াখালী বর্ষাকালীন মিনিবার গোল্ডকাপ নামক একটি খেলার আয়োজন করে সচেতন মহল। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ব্যারিস্টার মিজান সাঈদ নামের একজন বলেন, তরুণ প্রজন্মকে  সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আসক্তি থেকে দূরে রাখতে খেলাধুলায় আরও বেশি করে সম্পৃক্ত করা দরকার। খেলাধুলার মাধ্যমে যুবসমাজকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আসক্তি থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। খেলার মাঠ না থাকায় বর্তমান ছেলে-মেয়েরা মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এটা থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের এই আয়োজন।

কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি সারাদিন অফিস করি। অফিস শেষ করে বাসায় ফিরলে আমার ছেলে আমার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে গেমস ও ভিডিও দেখে। সে সারারাত ঘুমায় না। যার কারণে এখন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়াও করে না। তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। সে না খেয়ে থাকলেও মোবাইল ছাড়া থাকতে পারে না। এটা নিয়ে আমি খুব চিন্তিত।

ইসরাত জাহান নামের গৃহিণী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ১৫ বছর বয়সের ছেলে ও সাত বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। ছেলে স্কুলে গেলে আর তার বাবা অফিসে গেলে আমার ছোট্ট মেয়েকে দেখার জন্য কেউ নেই। আমি রান্নাঘরে গেলে তাকে মোবাইল দিয়ে রাখি। এখন আমার মেয়ে মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে। সে এখন মোবাইল ছাড়া থাকতে পারে না।

ইসমাইল নামের শহরের এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, চারদিকে বড় বড় দালান হওয়ায় খেলার মাঠ দখল হয়ে গেছে। তাই শিশুরা এখন মোবাইল গেমস বা টেলিভিশন দেখে সময় কাটায়।

কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলন ফোরামের সদস্য সচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোবাইল আসক্তি শিশুদের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি শিশু একবেলা না খেয়ে থাকতে পারলেও মোবাইল ছাড়া এক মিনিটও থাকতে পারে না। অধিকাংশ বাবা-মা তাদের শিশুদেরকে মোবাইল ফোনের আসক্তি থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করলেও আধুনিকতার দোহাই দিয়ে এটাকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে শিশুরা। কিন্তু মোবাইল ফোনে আসক্তি শিশুদের জন্য ভয়াবহ হুমকিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাঝে এ সমস্যাটি যেন প্রবল আকার ধারণ করেছে। তবে শিশু শ্রেণির ছেলে-মেয়েরা শুধু নয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র-ছাত্রীরা স্মার্টফোনের গেমে আসক্ত বেশি। এটা থেকে বের হতে হলে আমাদের খেলার মাঠের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

জেলা খেলাঘর আসরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপক শর্মা দীপু ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিশুদের নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য দায়ী মোবাইল আসক্তি। মোবাইলের কারণে ঠিকমতো পড়াশোনা হচ্ছে না। কার্টুনের মাধ্যমে শিশুদের কোমল মন অনৈতিক শিক্ষা পাচ্ছে। এসব বিষয়ে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com