মারাত্মক ভুল করেছেন নড়াইল জেলা ও দায়রা জজ: হাইকোর্ট

এক হত্যা মামলায় ‘নড়াইল জেলা ও দায়রা জজ আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনে কাগজাদি/বক্তব্য এবং পেশাগত অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে চার্জ গঠন পর্যায়ে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে মারাত্মক ভুল করেছেন, যা বেআইনি এবং ন্যায় বিচারের পরিপন্থি’।

২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের কালিয়ায় এনামুল শেখকে হত্যার ঘটনায় এক আসামিকে বাদ দিয়ে অভিযোগ গঠন বাতিল করে এক রায়ে এমন অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট। ২৮ আগস্ট এ রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো.মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ; যা আজ সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত হয়।

হাইকোর্টে ওই আসামি মল্লিক মাঝহারুল ইসলামের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন এএম আমিন উদ্দিন, রবিউল আলম বুদু। নড়াইল জেলা জজের পক্ষে ছিলেন মোহাম্মদ হোসেন।

২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নড়াইলের কালিয়া থানার চণ্ডিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশের রাস্তায় পূর্ব শত্রুতার জেরে এনামুল শেখকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কুপিয়ে জখম করা হয় আরো কয়েকজনকে।

এ ঘটনায় পরদিন বাদী হয়ে মল্লিক মাঝহারুলসহ ৬৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের ভাই মো. নাজমুল হুদা। ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি ওই ৬৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।

এই মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ করলে গত বছরের ২৯ নভেম্বর প্রধান আসামিকে জামিন দেন দায়রা জজ শেখ আব্দুল আহাদ। গত ১০ জুন প্রধান আসামিকে অব্যাহিত দিয়ে বাকি ৬৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। এই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন মামলা করেন মামলার বাদী। পরে হাইকোর্ট ওই অব্যাহতির আদেশ কেন বাতিল করা হবে না এই মর্মে রুল জারি করে। পাশাপাশি বিচারকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে রুলও জারি করা হয়। এই আদেশের পর গত ২২ জুলাই আসামি মাঝহারুল ইসলাম নড়াইল আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করলে আদালত তাকে জামিন দেন।রুল শুনানির সময় মাঝহারুলের জামিনের বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে এলে এই জামিন কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত।

২৯ আগস্ট অব্যাহতির আদেশ বাতিলের রুল মঞ্জুর, বিচারকের বিষয়ে জারি করা রুল নিষ্পত্তি এবং মাঝারের জামিন বাতিলের রুল খারিজ করে হাইকোর্ট রায় দেন।

রায়ে বলা হয়, ‘ফৌজদারি রুলটি জারির সময়ে অত্র আদালত প্রাথমিকভাবে অভিমত ব্যক্ত করে যে, তর্কিত আদেশ পর্যালোচনায় প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে, নড়াইলের দায়রা জজ এজাহার ও অভিযোগপত্রে আসামির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও, যা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দ্বারা সমর্থিত, আসামি কর্তৃক দাখিলকতৃ আত্মপক্ষ সমর্থনে কৈফিয়তের কাগজাদি/বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে আসামিকে অভিযোগ গঠন পর্যায়ে মামলা হতে অব্যাহতি দিয়েছেন।’

‘আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনে কৈফিয়তের কাগজাদি বিবেচনায় নিয়ে অভিযোগ গঠন পর্যায়ে আসামিকে মামলা হতে অব্যাহতি প্রদান কোনোভাবেই আইন সংগত নয় এবং প্রচলিত আইন এবং সুপ্রতিষ্ঠিত আইনি নীতির সুস্পষ্ট লংঘন। একজন দায়রা জজের নিকট এ ধরনের আদেশ প্রত্যাশিত নয়’।

রায়ে আদালত বলেন, ‘‘উপরোক্ত অভিমত বিবেচনায় নিয়ে অত্র আদালত নড়াইলের দায়রা জজ শেখ আব্দুল আহাদ-কে আইন বহির্ভূতভাবে মাঝহারুলকে মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান করায় কেন তার বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহার করা হবে না’-তা অত্র আদালতকে লিখিতভাবে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। ন্যায় বিচারের স্বার্থে উভয় রুল একত্রে শুনানির জন্য গ্রহণ করা হয় এবং একই রায়ের মাধ্যমে রুল দুটি নিষ্পত্তি করা হলো।’’

চার্জ গঠনের দিন মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করলে দায়রা জজ অব্যাহতির এই দরখাস্তটি মঞ্জুর করে মাঝহারুলকে মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন।

‘আদালতের আগের নজিরসমূহ নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এজাহার বা অভিযোগপত্রে আসামীর নামি উল্লেখ থাকলেই যেমন যান্ত্রিকভাবে অভিযোগ গঠন করা সমীচীন নয়, তেমনি কোনো আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক/আপাত যথার্থতা থাকলে অভিযোগ গঠন পর্যায়ে তাকে অব্যাহতি দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। অভিযোগ গঠন পর্যায়ে আসামির বিরুদ্ধে আনিত আপাতদৃষ্ট অভিযোগটি সত্য কিংবা মিথ্যা তা নির্ধারণ করার সুযোগ নেই; সেটি নির্ধারণ হবে বিচার প্রক্রিয়ার শেষে উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে।’

রায়ে বলা হয়, ‘ঘটনার দিন ও সময়ে মাঝহারুল সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন’-তার এই ‘অজুহাত’ বা ‘দাবী’ আইন অনুযায়ী তাকেই প্রমাণ করতে হবে। এই ‘অজুহাত’ বা ‘দাবি’ অভিযোগ গঠন পর্যায়ে বিবেচনায় নিয়ে কোনো অভিযুক্তকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।’

আদালত রায়ে আরও বলেন, ‘উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমাদের সুচিন্তিত ও দ্বিধাহীন অভিমত এই যে, দায়রা জজ আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনে কাগজাদি/বক্তব্য এবং পেশাগত অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে চার্জ গঠনপর্যায়ে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে মারাত্মক ভুল করেছেন, যা বে-আইনি এবং ন্যায় বিচারের পরিপন্থি।’

‘তবে আমাদের সুচিন্তিত অভিমত এই যে, সাময়িকভাবে হলেও নড়াইলের দায়রা জজ শেখ আব্দুল আহাদের দায়রা মামলা সংক্রান্ত বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ স্থগিত করা প্রয়োজন,’ যোগ করেন আদালত।

এ বিষয়ে হাইকোর্টে দেওয়া নড়াইল জেলা জজের জবাবটি পড়ে ‘আমাদের কাছে আরো মনে হয়েছে যে, বিজ্ঞ বিচারক অনিচ্ছাকৃতভাবে আইনগত ভুল করেছেন এ ধরনের কোনো আত্ম-উপলব্ধি বা অনুশোচনার অবস্থান থেকে ক্ষমা চাননি; বরং মনে হচ্ছে যে, যেহেতু হাইকোর্ট বিভাগ ভুল ধরেছে কেবলমাত্র সে কারণেই তিনি ভুল স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। সুতরাং, সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় আমাদের সুচিন্তিত অভিমত এই যে, নড়াইলের বর্তমান বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ শেখ আব্দুল আহাদকে আগামী ১ (এক) বৎসরের জন্য দায়রা মামলা পরিচালনা থেকে বিরত রাখা প্রয়োজন; যাতে এ সময়ের মধ্যে বিজ্ঞ বিচারক দায়রা মামলা পরিচালনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারেন’ বলেও রায়ে উল্লেখ করেন হাইকোর্ট।

হাইকোর্টের এ অভিমত সম্পর্কে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের জন্য বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের কাছে উত্থাপনের জন্য আইন সচিব ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে রায়ে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • বৃহস্পতিবার (রাত ৪:১৫)
  • ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১৬ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com