আবরারকে পেটান ছাত্রলীগের ১০ নেতা-কর্মী

বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে সরাসরি মারধর করেছিলেন ছাত্রলীগের অন্তত ১০ নেতা-কর্মী। তাঁদের তিনজন ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে তাঁকে বেধড়ক পেটান। দুজন ব্যবহার করেন প্লাস্টিকের মোটা দড়ি (স্কিপিং রোপ)। পাঁচজন কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড় মারেন। এভাবে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার নির্যাতনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন আবরার। এই হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা পুলিশ ও আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য দিয়েছেন।

৬ অক্টোবর দিবাগত রাতের এই নৃশংস ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে আটজন নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৬ জন মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। এজাহারভুক্ত আরও তিন আসামি এখনো পলাতক।

জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা জানিয়েছেন, শিবিরের সঙ্গে আবরারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে—এমন তথ্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দিয়েছিলেন তাঁরই রুমমেট মিজানুর রহমান। আর আবরারকে কক্ষে এনে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আবরার হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ২৮ জন জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। তবে তাঁদের সবাই মারধরে অংশ নেননি। অধিকাংশ ব্যক্তিরাই যুক্ত হয়েছিলেন ছাত্রলীগ নেতার নির্দেশে। কেউ কেউ আবরারকে পানি খাওয়াতে ও শুশ্রূষা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক অনিক সরকারের কারণে তা সম্ভব হয়নি। আবরারকে বেশি মারধর করেন অনিক।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই ২৮ জনের বাইরে ঘটনার সঙ্গে মুঠোফোনে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রাসেল, আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা, সহসভাপতি তাহসিন ইসলাম, গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ, সাহিত্য সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামান এবং উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ যুক্ত ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদ করে শিবিরের নেতা-কর্মীদের নাম বের করার নির্দেশ দেন মেহেদী হাসান। আর ঘটনা নিয়ে ফেসবুকের মেসেঞ্জার গ্রুপে আলোচনায় অংশ নেন অমিত সাহা। আবরার কক্ষে আছেন কি না, সে তথ্য নিশ্চিত করেন মনিরুজ্জামান। ঘটনা চলার সময়ে আবরারের পরিস্থিতি নিয়ে মুঠোফোনে অবহিত ছিলেন মুজতবা রাফিদ, তাহসিন ইসলাম ও ইসতিয়াক আহমেদ।

আবরারকে কক্ষ থেকে নিয়ে যান ১৫ জন

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সমাজসেবাবিষয়ক উপসম্পাদক ইফতি মোশাররফ ওরফে সকাল বলেছেন, রাত আটটার কিছু পর আবরারকে নিয়ে মুনতাসির আল জেমি, আলিম, তোহা, মাজেদ, রাফাত, শামিম, মোরশেদ, রাফিদ ইমাম, মোয়াজ, গালিব, সাইফুল ২০১১ নম্বর কক্ষে আসেন। তবে নাজমুস সাদাত তাঁর জবানবন্দিতে তানিম, সাখাওয়াত, অভি, আবু নওশাদ সাকিব, শাহিন, হাফিজুর রহমানসহ আরও কয়েকজনের নাম বলেন।

নাজমুস সাদাত আরও বলেছেন, ২০১১ নম্বর কক্ষে গিয়ে তাঁরা ইফতি মোশাররফ সকাল, মুজাহিদুর রহমান, মনিরুজ্জামান, তানভীর, মুজতবা রাফিদ ও আকাশ হোসেনকে দেখেছেন। আর ইফতি মোশাররফ বলেছেন, আবরারকে নিয়ে আসার আগেই কক্ষে মুজতবা রাফিদ ও বিটু ছিলেন। কিছুক্ষণ পর যান তানভীর ও মুজাহিদ। আবরারের একটি মুঠোফোনে কিছু সময় তল্লাশি চালিয়ে মুজতবা রাফিদ দিনাজপুর চলে যান। পরে সেই ফোনে তল্লাশি করেন তানভীর।

মারধর করেন ১০ জন

বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সমাজসেবাবিষয়ক উপসম্পাদক ইফতি মোশাররফ ওরফে সকালের ভাষ্যমতে, আবরারকে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে প্রথম চড় মারেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন। এরপর ইফতি ক্রিকেটের স্টাম্প আনতে বলেন। শামসুল আরেফিন রাফাত একটি স্টাম্প তাঁর হাতে দেন। ইফতি আবরারকে চার-পাঁচটি বাড়ি দিলে স্টাম্পটি ভেঙে যায়। এরপর মুনতাসির আলম ওরফে জেমি আরেকটি স্টাম্প নিয়ে আসেন। আবরারকে তখন ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক অনিক সরকার বুয়েটে শিবিরের কে কে আছে জিজ্ঞাসা করছিলেন আর চড় মারছিলেন। অনিক তখন স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু, পা, পায়ের তালু এবং বাহুতে মারতে থাকেন। আবরার হঠাৎ উল্টাপাল্টা কিছু নাম বলতে শুরু করলে বুয়েট ছাত্রলীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম ওরফে জিয়ন তাঁকে চড় মারেন এবং হাঁটুতে স্টাম্প দিয়ে বাড়ি দেন। রবিন, অনিক ও জিয়ন একসময় কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। এ সময় আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান ওই কক্ষে আসেন।

ইফতি জিজ্ঞাসাবাদে জানান, ছাত্রলীগের সদস্য মুজাহিদুর রহমান তখন কক্ষে থাকা স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারেন। তখন ইফতি আবার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু ও পায়ে মারেন। এ সময় খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম চড়-থাপ্পড় মারেন। রাত ১১টার দিকে অনিক আবার এলোপাতাড়িভাবে আবরারের শরীরে শতাধিক আঘাত করেন।

নাজমুস সাদাত বলেছেন, তিনিসহ জেমি ও এহতেশামুল রাব্বী আবরারকে চড় মারেন। শামীম বিল্লাহ স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারেন।

শুশ্রূষা করতে বাধা 

নাজমুস সাদাত জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, আববার অসুস্থ হয়ে পড়লে মনির তখন মোর্শেদকে ফ্যান আনতে বলেন। মোর্শেদ ফ্যান নিয়ে এলে অনিক ফ্যান দিতে নিষেধ করেন। আবরারকে পানি খাওয়াতে চাইলে ইফতি বাধা দেন। আবরারকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা বললে অনিক, ইফতি ও রবিন বলেন, ‘ওর কিছুই হয়নি।’

ইফতি মোশাররফ জিজ্ঞাসাবাদে বলেন, আবরারকে পুলিশের হাতে দেওয়ার জন্য নিচে নামাতে বলেন রবিন। তখন নিচে নেমে হলের মেইন গেটে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিলেন রাসেল। এ সময় জেমি দৌড়ে এসে বলেন, আবরারের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ইসমাইল ও মনির তখন অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দেন। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় তামিম বাইক নিয়ে বুয়েট মেডিকেলের ডাক্তার নিয়ে আসেন। ডাক্তার সিঁড়ির লেন্ডিংয়ে আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও মারা গেছে।’

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • শুক্রবার (বিকাল ৫:০২)
  • ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি
  • ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ (বসন্তকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com