মানিকগঞ্জের শিবালয় থেকে সাড়ে নয় মণ শিম নিয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আসেন হাবিবুর রহমান। স্থানীয় চাষিরা তার কাছে বিক্রি করেছেন প্রতি কেজি ১৮ থেকে ২০ টাকায়। পরিবহন খরচ হিসাব করে তিনি আড়তে কেজিপ্রতি দাম নেন ৪০ টাকা। কারওয়ান বাজার থেকে সেই শিম ৫০ টাকায় কেনেন ঠাটারী বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী ইয়াকুব আলী। সাধারণ ভোক্তার ঘরে তা যাচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। এই চিত্র গতকাল মঙ্গলবার সকালের।
শীতকালের জনপ্রিয় সবজি শিম, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, লাউ, মুলা, মিষ্টিকুমড়া, বরবটি, লাল-সবুজ শাক চাষি থেকে ভোক্তার ঘরে পৌঁছাতে অন্তত তিন হাত বদল হয়। এতেই দাম বৃদ্ধি পায় দ্বিগুণ থেকে পাঁচগুণ। বিশেষ করে এক কেজি টমেটো বিভিন্ন এলাকার চাষিরা বিক্রি করেন ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। ঢাকার বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। চাষির ২০ টাকার কচুরমুখিও বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজার ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চাষ হয়েছে। অতিবৃষ্টি বা ঘূর্ণিঝড় বুলবুলও সবজিবিপ্লব থামাতে পারেনি। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এমন কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায়নি, যা কৃষকের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তার পরও ভরা মৌসুমে শীতকালীন সবজির দাম বেশি কেন- এ প্রশ্নের উত্তর মেলানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ভোক্তা সাধারণের মাথায় হাত।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির সমকালকে বলেন, ‘যে যেভাবে পারছে দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে। বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। রাষ্ট্রের যারা এগুলো দেখভাল করার কথা, তারা লোকবল সংকটের অজুহাত দেখায়। অথচ যারা দায়িত্বে আছেন, তারাও কোনো কাজ করেন না। ফলে মাফিয়া চক্র সুযোগ নিচ্ছে। ঠকছে সাধারণ ভোক্তা।’
দেশের বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, লালশাক, সবুজশাক, মুলা, পালংশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ডাঁটাশাক, শিম, বেগুন, শসা, ঢেঁড়স, গাজর এবং লাউ বাজারে উঠছে। এরই মধ্যে জমে উঠেছে শীতকালীন সবজির বাজার। পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে আলাপকালে তাদের প্রবল দাবি- ঘূর্ণিঝড় বুলবুল এবং অতিবৃষ্টির কারণে এবার শীতকালীন সবজির ফলনে ব্যাঘাত ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ যোগ হয় পরিবহন খাতের ধর্মঘট। এসব কারণে সবজির দাম চড়া।
তবে আগারগাঁও আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন সমকালকে বলেন, ‘দেশের যেসব অঞ্চলে শীতকালীন সবজির আবাদ বেশি হয়, সেখানে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়েনি। অতিবৃষ্টিও হয়নি। সাধারণত ঘনকুয়াশা হলে সবজির আবাদে বিরূপ প্রভাব পড়ে। কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত সে রকম কোনো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাব দক্ষিণাঞ্চলে কিছুটা পড়েছে। তাতে ধানের ক্ষতি হলেও সবজির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়নি বলেই জানি। সামগ্রিকভাবে সারাদেশে সবজি চাষের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলের বৃষ্টির দোহাই দেওয়া উচিত না।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে কিছু সবজি নষ্ট হলেও সামগ্রিকভাবে তা লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রভাব ফেলছে না বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান। তবে তিনি বলেন, ‘বপনের সময় কিছু বীজ নষ্ট হয়েছিল বৃষ্টিতে। তার একটি প্রভাব পড়ছে মনে হচ্ছে। এ ছাড়া শীতের শুরুতে দাম একটু চড়া থাকেই। আগামী ১০ দিনের মধ্যে দাম কমে আসবে।’
এদিকে, দেশে প্রতি বছরই সবজির আবাদ বাড়ছে। স্বাধীনতার পর দেশে সবজির চাষ পাঁচগুণ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে অনাবাদি থাকছে না কোনো জমি। একইসঙ্গে বেড়েছে চাহিদাও। মৌসুমের শুরুতে কেবল যশোর থেকেই সারাদেশে প্রতিদিন সরবরাহ হচ্ছে অন্তত ৮০ ট্রাক সবজি।
যেভাবে দাম বাড়ে :বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের অনেকেই সরাসরি পাইকারি বাজারে নিয়ে সবজি বিক্রি করতে পারেন না। কেউ পরিবহন খাতের ঝামেলা এড়াতে মাঠেই সবজি বিক্রি করে দেন। কেউ আবার নিকটস্থ বাজারে গিয়ে ফড়িয়ার কাছে বিক্রি করেন। অনেকে যেতে পারেন না নানারকম প্রতিবন্ধকতার কারণে।
রাজধানীসহ সারাদেশে কয়েকটি বাজার থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্নেষণ করে সবজির তিন ধরনের মূল্য পাওয়া গেছে। চাষিরা বিক্রি করেন প্রতি কেজি শিম ১৮-২০ টাকা, বেগুন ২০-২২ টাকা, মাঝারি সাইজের ফুলকপি ৩০-৩২ টাকা, মাঝারি সাইজের বাঁধাকপি ১৫-১৮ টাকা, টমেটো ৪০-৪৫ টাকা, লাউ ২৫-৩০ টাকা, মুলা ২০-২২ টাকা।
পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি শিম ৪০-৪৫ টাকা, বেগুন ৩৫-৪০ টাকা, মাঝারি সাইজের ফুলকপি ৪৫-৫০ টাকা, মাঝারি সাইজের বাঁধাকপি ২৫-৩৫ টাকা, টমেটো ৬০-৭০ টাকা, লাউ ৩৫-৪৫ টাকা, মুলা ২৫-৩০ টাকা।
সর্বশেষ খুচরা বাজারে প্রতি কেজি শিম ৬০-৭০ টাকা, বেগুন ৫০-৬০ টাকা, মাঝারি সাইজের ফুলকপি ৫০-৬০ টাকা, মাঝারি সাইজের বাঁধাকপি ৩৫-৪০ টাকা, টমেটো ৯০-১০০ টাকা, লাউ ৫০-৬০ টাকা, মুলা ৩০-৪০ টাকা।
মানিকগঞ্জ থেকে কারওয়ান বাজারে শিম বিক্রি করতে আসা হাবিবুর রহমান দরের নানা তারতম্যের বিষয়ে বলেন, ‘আমরা কৃষকের ক্ষেতে গিয়ে সবজি সংগ্রহ করি। আবার তা ঢাকার বাজারে আনা পর্যন্ত পরিবহন বাবদ অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। আবার আড়তে বিক্রি করতে গেলে মণপ্রতি দুই কেজি বেশি সবজি দিতে হয়। পথে পথে বখরা তো আছেই। এসব কারণে আড়তে যাওয়া পর্যন্ত সবজির দাম বেড়ে যায়।’
রাজধানীর ঠাটারী বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী ইয়াকুব আলী বলেন, ‘এবার অন্য বছরের চেয়ে শাকসবজির দাম চড়া। কারণ বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির কারণে সবজি নষ্ট হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণেও কিছু ক্ষয়ক্ষতির কথা শুনেছি। আবার ধর্মঘটের কারণে কিছুদিন সবজি আসেনি। এ জন্য দাম বেশি।’
যশোর সদরের চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের আব্দুলপুর গ্রামের নাজমুল ইসলাম জানান, এবার তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে বাঁধাকপির চাষ করেছেন। বাজারজাতে দাম ভালো পাচ্ছিলেন। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে কয়েকদিন দাম নিয়ে ঝামেলায় পড়েছিলেন। এখন আবার আশানুরূপ দাম পাচ্ছেন।
চুড়ামনকাটি গ্রামের রুহুল ও বাগডাঙ্গা গ্রামের সবজিচাষি লিটু জানান, এখন পুরোদমে সবজি বাজারজাতের সময়। দাম নিয়ে এখনও সন্তুষ্ট তারা। তবে খুচরা বাজারে যে দাম, সে অনুযায়ী কৃষক যে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন, তা বলা যাবে না।
নরসিংদীর ভেলানগর বাজারে পলাশ উপজেলার নোয়াকান্দা গ্রামের ফুলকপি চাষি সুলতান মিয়া জানান, প্রতিটি ফুলকপি উৎপাদনে গড়ে প্রায় ১৮ টাকা খরচ পড়ে। সে হিসাবে এবার ভালো দাম পাচ্ছেন।
দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পাইকারি সবজির মোকাম যশোর সদর উপজেলার বারীনগর এবং চুড়ামনকাঠি। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এ মোকাম থেকে প্রতিদিন অন্তত ৬০ থেকে ৮০ ট্রাক সবজি ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হচ্ছে।
এ মোকামে সবজি বিক্রি করতে আসা চাষি জামাল হোসেন, শাহাদৎ হোসেন, ফজর আলী, মনির উদ্দিনসহ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বর্তমানে তারা সবজির দাম পেয়ে সন্তুষ্ট। তবে মধ্যস্বত্বভোগীদের হস্তক্ষেপ না থাকলে আরও ভালো দাম পেতেন। খুচরা বাজারে তুলনামূলক বেশিই দাম নেওয়া হচ্ছে।
ছাড়িয়ে যাবে লক্ষ্যমাত্রা :কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এবার যশোরের আট উপজেলায় সাড়ে ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে সবজির চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়। উপপরিচালক মো. এমদাদ হোসেন সেখ জানান, ইতোমধ্যে ১৩ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ সম্পন্ন হয়েছে। মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। যশোর সদর উপজেলার হৈবতপুর ইউনিয়নে সর্বাধিক এক হাজার ৬৩০ হেক্টর, চুড়ামনকাটি ইউনিয়নে ৮২৮ হেক্টর ও কাশিমপুর ইউনিয়নে ৫৫৩ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির চাষ হয়েছে।
অন্যদিকে, নরসিংদীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, শীতকালীন সবজি চাষ করা হয়েছে আট হাজার ৮২২ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ফুলকপি ৭৮০ হেক্টর, বাঁধাকপি ২৫০ হেক্টর, শিম দুই হাজার ৫০৫ হেক্টর, লাউ এক হাজার ১৮ হেক্টর, টমেটো ৪৯৩ হেক্টর, বেগুন ৮২১ হেক্টর, লালশাক ৪২২ হেক্টর, পালংশাক ১৩৫ হেক্টর, মুলা ৪৯০ হেক্টর, শসা ১২০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে এখানেও।
এ ছাড়া মানিকগঞ্জে এবার নয় হাজার ১৭৫ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সাত হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়েছে। শীত মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই এখানে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে।