আজ ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৭১ বছর পূর্তির দিন। এ বছর দিবসটি উপলক্ষে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস মানুষের জীবনে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজের ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাপী তরুণ জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের অধিকার, নারী-পুরুষের সমধিকার, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ও স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাচ্ছে, সংগঠিত ও সোচ্চার হচ্ছে।
তাদের এ সম্মুখযাত্রা ভবিষ্যৎ শান্তি, ন্যায়পরায়ণতা ও সমান সুযোগ লাভের লক্ষ্যে পরিচালিত। কারণ প্রতিটি ব্যক্তি নাগরিক, রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার পাওয়ার যোগ্য। তার বর্ণ, ধর্ম, সামাজিক উৎস, লিঙ্গ, রাজনৈতিক মতাদর্শ, শারীরিক সক্ষমতা-অক্ষমতা, আয় অথবা অবস্থান যাই হোক না কেন।’
বাণীর উপসংহারে জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী প্রত্যেককে যুবসমাজের প্রতি সমর্থনদান ও তাদের রক্ষার আহ্বান জানান।
অন্যদিকে দিবসটিকে উপলক্ষ করে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার মিচেল ব্যাচেলেট তার বাণীতে বলেছেন, ‘যে কোনো বিবেচনায় প্রতিটি মানুষের বৈষম্য-বঞ্চনা থেকে মুক্ত হয়ে বাঁচার অধিকার রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকেরই শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ন্যায়ানুগ আর্থিক সুবিধা, শোভন জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। সে জন্য অধিকতর দৃঢ় মনোবল নিয়ে মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।’
এ কথা সত্য, বর্তমানে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে মানবাধিকার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শিশু, নারী, নিপীড়নের শিকার ব্যক্তি, বিশেষ চাহিদার প্রতিবন্ধী মানুষ আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি দ্বারা আশ্রয় ও রক্ষা পাচ্ছেন। ১৯৪৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ১৮ চুক্তি, উল্লেখযোগ্য প্রটোকল ও সমঝোতা ব্যবস্থায় মানবাধিকার উন্নীত হয়েছে।
৫৭টি দেশে জাতীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ১০৪ দেশে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ হয়েছে। ১৯৪৮ সালে মানবাধিকার ঘোষণা অনুমোদনের সময় মাত্র ৯টি দেশে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ ছিল। অধিকাংশ রাষ্ট্রে এখন জাতীয় পার্লামেন্ট রয়েছে। ৭০ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ২৬টি। বর্তমানে ১৯৮ দেশে নারীর ভোটাধিকার রয়েছে।
’৪৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯১। অধিকতর স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রাপ্তির সমর্থনের আইন ১১১ দেশে প্রণীত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১৫টি দেশ গত ৪ বছর এসব আইন মেনে চলেছে। ১৬৯ দেশে নাগরিকরা আন্তর্জাতিক সনদ, চুক্তি ও সমঝোতার আলোকে রাজনৈতিক, সামাজিক অধিকার, নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ভোটাধিকার প্রয়োগ ও প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পাচ্ছেন।
কিন্তু দেশে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ যতটা গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার পায়, মানবাধিকার কী, মানবাধিকার বলতে প্রকৃতপক্ষে কী বোঝায়, এর সংজ্ঞা, পরিধি বা বিষয়বস্তু সেভাবে গুরুত্ব পায় না।
এ দিকটি বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘ ও এর বিভিন্ন সংস্থা, সহযোগী সংগঠন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানবাধিকার শিক্ষা বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে। বিভিন্ন দেশের পাঠ্যসূচিতে তা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।
১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২৬ ধারায় বলা হয়েছে : ‘প্রত্যেকের শিক্ষা লাভের অধিকার আছে। শিক্ষা হবে নিখরচায়, অন্তত প্রাথমিক ও মৌলিক পর্যায়গুলোতে। প্রাথমিক শিক্ষা হবে বাধ্যতামূলক। কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা সাধারণভাবে সহজলভ্য হবে এবং উচ্চশিক্ষায় সবার অভিগম্যতা থাকবে, যা হবে মেধার ভিত্তিতে’।
দীর্ঘ ৬৭ বছর পর ২০১৫ সালে প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধি জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক সভায় মিলিত হয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বকে বদলে দিতে ১৭টি লক্ষ্য অনুমোদন করেছেন, যেখানে কারিগরি বৃত্তিমূলক ও উচ্চশিক্ষাকে যুক্ত করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ একটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উল্লেখ থাকলেও অদ্যাবধি তার বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় মানবাধিকার শিক্ষার উল্লেখ থাকলেও দীর্ঘদিন এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার অথবা এনজিওগুলোর দিক থেকে কোনো উদ্যোগ না থাকার প্রেক্ষাপটে ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ ভিয়েনায় একটি বিশ্ব সম্মেলনের আয়োজন করে। এ সম্মেলন থেকে পরিস্থিতির যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচিত হয়।
সৃষ্টি হয় জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের পদ, যার দফতরে মানবাধিকার সংক্রান্ত শিক্ষা ও জনসাধারণের জন্য প্রাপ্তব্য তথ্য সরবরাহের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনের ঘোষণা ও কার্যক্রমে জাতিসংঘের ১৭১ সদস্য রাষ্ট্র অনুমোদন দেয়।
এরই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘ ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সালকে ‘মানবাধিকার শিক্ষার দশক’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর ফলশ্রুতিতে মানবাধিকার শিক্ষা নিয়ে বিস্তর প্রকাশনা ও কর্মসূচি গ্রহণ শুরু হয়। ২০০৫ সালে জেনেভায় অবস্থিত জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের দফতর থেকে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার শিক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
এ কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল মানবাধিকার শিক্ষার মৌলিক নীতি ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে সর্বসম্মত ও গ্রহণযোগ্য ধারণা প্রদান এবং সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমের কাঠামো প্রণয়ন ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে তৃণমূল পর্যায়ে অংশীদারিত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করা।
পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে মানবাধিকার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণসংক্রান্ত ঘোষণা গৃহীত হয়। যেখানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে মানবাধিকার শিক্ষা প্রদানের বিষয় স্থিরীকৃত হয়। সে সঙ্গে এ বিষয়ে শিক্ষক, আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, সরকারি কর্মকর্তা ও সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট সবার প্রশিক্ষণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বাংলাদেশে মানবাধিকার শিক্ষা : আমাদের দেশে মানবাধিকার শিক্ষা পাঠ্যক্রমে সেভাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। শিক্ষকের পাঠদানের ব্যবহারসূচিতেও তার স্থান ছিল না। ২০১৩ সালে ও তার পরে প্রকাশিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে মানবাধিকার বিষয়টি আগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
শিশু, নারী ও প্রবীণের অধিকার সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ৬ষ্ঠ শ্রেণির বইতে বলা হয়েছে : ‘প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাঁচটি অধিকার দাবি করতে পারে : খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। এগুলো একজন মানুষের মৌলিক চাহিদা। আবার এগুলো তার মৌলিক অধিকারও।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল নাগরিকদের জন্য এই অধিকারগুলো পাওয়া নিশ্চিত করা।’ শিশু অধিকার প্রসঙ্গে এতে বলা হয়েছে : ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু। সব শিশুর অধিকার সমান। অর্থাৎ ছেলেমেয়ে, ধনী-গরিব, জাতীয়তা, ধর্ম, শারীরিক সামর্থ্য কোনো কিছুতেই শিশুদের অধিকারের তারতম্য করা যাবে না।
বাবা-মা ও বড়দের শিশুর অধিকার সম্পর্কে সচেতন থেকেই তাদের সদুপদেশ দিতে ও পথ চলতে সাহায্য করতে হবে। শিশু তার নিজের ও বাবা-মায়ের নামসহ সঠিক পরিচয় ব্যবহারের অধিকারী হবে। শিশুর বেঁচে থাকা ও বড় হওয়ার অধিকার রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
মা-বাবার নির্দেশনায় শিশুর স্বাধীন চিন্তাশক্তির প্রকাশ, বিবেক-বুদ্ধির বিকাশ এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। মারধর কিংবা অন্যায় বকাঝকা থেকে শিশুকে রক্ষা করার ব্যাপারে সরকারের দায়িত্ব আছে। শিশুরা যাতে সময়মতো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ পায় রাষ্ট্রকে তা নিশ্চিত করতে হবে।
সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতির শিশুদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষাচর্চার অধিকার রক্ষা করতে হবে। প্রতিটি শিশুর অবকাশ যাপন, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের অধিকার রয়েছে। অর্থনৈতিক শোষণ এবং যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুর বিরত থাকার অধিকার রক্ষা করতে হবে। শিশুকে কেউ যেন অন্যায় কাজে ব্যবহার করতে না পারে।
শিশুর শারীরিক-মানসিক-নৈতিক ক্ষতি যাতে না হয়, রাষ্ট্রকে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো শিশুকে যুদ্ধে বা সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে দেয়া যাবে না। শিশুর সম্মানবোধ, নিজস্ব গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।
প্রবীণদের অধিকার প্রসঙ্গে সপ্তম শ্রেণির বইতে বলা হয়েছে : ‘আমাদের দেশে সাধারণত ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষকে প্রবীণ বলে গণ্য করা হয়। কারণ ওই বয়সের পর মানুষ দৈনন্দিন জীবিকা উপার্জনের কাজ থেকে অবসর নেয়। বাংলাদেশে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স ৫৯ বছর।
বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কোনো কোনো পেশাজীবীদের জন্য বয়সের এই সীমা সম্প্রতি ৬৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। যদিও ওই বয়সের পরও যেসব মানুষ তার কাজ করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে, তা নয়। তবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও ৬০ বা ৬৫ বছর বয়সের পর একজন মানুষকে প্রবীণ বা ‘সিনিয়র সিটিজেন’ গণ্য করা হয়।
সমাজে তাদের বিশেষ সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। জাতিসংঘ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় কতিপয় নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এ ছাড়াও জাতিসংঘ প্রবীণদের অধিকার ও তাদের প্রতি কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে একটি বিশেষ দিনকে ‘প্রবীণ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।’
মানবাধিকার চর্চা ও অনুশীলন প্রসঙ্গ : তবে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হলেই মানবাধিকার চর্চা ও অনুশীলন নিশ্চিত হয়ে যাবে, এমন কথা ভাবার কারণ নেই। পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে, ব্যক্তিজীবনে আমরা তা কীভাবে প্রয়োগ করি, তার ওপরই এর কার্যকারিতা বেশি নির্ভর করে।
আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত মানবাধিকার চর্চা ও বাস্তব প্রয়োগে অভ্যস্ত না হয়ে উঠব, ভিন্নমতের প্রতি সহনশীল হয়ে শ্রদ্ধা করতে না শিখব, ততদিন পর্যন্ত তা কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাবে না।
সমাজের পারিপার্শ্বিকতা, জাতীয় নেতৃত্বের অবস্থান, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মূল্যবোধ, সামাজিক প্রগতিতে আস্থা, ইতিবাচক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেয়ার ও যথাযথ ভূমিকা পালনের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিবেচ্য।
এ প্রেক্ষাপটে আজ ১০ ডিসেম্বর সর্বজনীন মানবাধিকার দিবস পালিত হচ্ছে। মানবাধিকার শিক্ষার পটভূমি ও তা নিয়ে উদ্যোগের প্রসঙ্গটি এখন তুলনামূলকভাবে আগের চেয়ে স্পষ্ট হলেও মানবাধিকার শিক্ষা কী, সেখানে শিক্ষার্থী, তার শিক্ষক ও অভিভাবক, শিক্ষা প্রশাসন কীভাবে সম্পৃক্ত হবে, কার দায় ও করণীয় কতটুকু তার স্পষ্টায়ন প্রয়োজন।
বিশেষ করে শিক্ষার্থীর সম্ভাব্য উন্নয়ন ভাবনা, তার অনুকূল ও প্রতিকূলে বিরাজমান পরিস্থিতি ও নীতিমালার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন দরকার। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে প্রথা-সিদ্ধান্ত আলোচনার পাশাপাশি মানবাধিকার শিক্ষার বিষয়টি অধিকতর বিবেচনা ও গুরুত্বের দাবি রাখে।
মানবাধিকার শিক্ষা নিয়ে সৃজনশীল, বাস্তবসম্মত ভাবনা ও সময়োচিত উদ্যোগের বড় বেশি প্রয়োজন।