লন্ডভন্ড সবকিছু, বিধ্বস্ত স্বপ্নের রেললাইনও

আকস্মিক পাহাড়ি ঢল এবং টানা বৃষ্টিতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের তিন উপজেলা সাতকানিয়া-লোহাগাড়া-চন্দনাইশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।

মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) থেকে বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) পর্যন্ত টানা তিনদিনে পানিবন্দি হয়ে পড়ে কয়েক লাখ মানুষ। ওই এলাকার স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ বন্যায় রোববার পর্যন্ত শিশু বৃদ্ধসহ মোট ১৭ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। সরেজমিন দেখা যায়, তিন উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকায় বেশিরভাগ মাটির ঘর ভেঙে গেছে। এছাড়া অন্যান্য কাঁচাঘরও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে পাকাঘরের আসবাবপত্র। এই তিন উপজেলার বুক চিরে যাওয়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ও কেরানিহাট-বান্দরবান সড়কের বিভিন্ন অংশ ক্ষয়ে গেছে। এছাড়া দুটি সড়কের বিভিন্ন অংশ পানিতে তলিয়ে যায়। টানা দুদিন সড়কের ওপর কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমর পর্যন্ত পানি ছিল। ওইসময়ে যানচলাচল প্রায়ই বন্ধ ছিল।পানি নামার পর সড়কে বড় বড় গর্ত দেখা যায়। বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কের কোনো কোনো অংশ স্রোতে ভেসে গেছে। ফলে ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এছাড়া এই তিন উপজেলার ফসলের ক্ষেত থেকে মাছের খামার প্রায় সবই তলিয়ে গেছে।সাতকানিয়ার বন্যাকবলিত ছদাহা ইউনিয়নের আঞ্চলিক প্রধান সড়ক দস্তিদার হাট থেকে মিটাদিঘী পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার সড়কে শতাধিক স্থানে ভাঙন দেখা গেছে। এছাড়া খানাখন্দে ভরা সড়কটি দিয়ে এখন যাতায়াতের উপায় নেই।

একই ইউনিয়নের ফকিরহাট থেকে পূর্ব ছদাহা সড়কের বিভিন্ন অংশে ভাঙনের কারণে অনেকটাই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বাজালিয়া ইউনিয়নের মাহালিয়া সড়কের দশাও বেহাল।

শুধু এই একটি দুটি নয়, পুরো সাতকানিয়া উপজেলার বন্যা কবলিত ১৭ ইউনিয়ন এবং পৌরসভা এলাকার চিত্র এমনই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশ উপজেলার বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকার সড়কের কোথাও মাটি ক্ষয়ে গেছে, কোথাও আবার পলেস্তারা একেবারে ভেসে গেছে। ফলশ্রুতিতে এসব এলাকার সড়কগুলো অনেকটাই চলাচলের অনুপযোগী।

এ বিষয়ে এলজিইডি নির্বাহী পরিচালক (চট্টগ্রাম) মোহাম্মদ হাসান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্যায় বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমাদের টিম মাঠে কাজ করছে। তারা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করছেন। কয়েকদিনের মধ্যে এ কাজটি শেষ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাব। এরপর সড়কগুলো দ্রুত মেরামত করে চলাচল উপযোগী করা হবে।

বিধ্বস্ত স্বপ্নের দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন

বন্যার কারণে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নির্মাণাধীন দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন। ট্রেন চলাচল শুরুর আগেই এখানে লাইনের বিভিন্ন অংশে দেবে গেছে।

শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, কেরানিহাট ও তেমুহনী কেঁওচিয়া এলাকার দুই কিলোমিটার রেললাইনের অন্তত ২০ স্থানে দেবে গেছে। বিভিন্ন স্থানে পাথর সরে গিয়ে পার্শ্ববর্তী জমিতে পড়েছে। এছাড়াও লাইনের বিভিন্ন অংশের মাটি ক্ষয়ে গেছে।

অথচ আগামী সেপ্টেম্বর থেকে এই লেন দিয়ে ট্রেন কক্সবাজার যাওয়ার কথা ছিল। সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক এ প্রকল্পে এ পর্যন্ত ৮৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

ট্রেন চালুর ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে না বন্যা

যদিও বন্যার এ ক্ষয়ক্ষতি যথাসময়ে ট্রেন চালুর ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্যার কারণে সাতকানিয়া উপজেলার তেমুহনী মৌজায় আধ-কিলোমিটারের মতো অংশে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে পানির ঘূর্ণির কারণে রেললাইনের নিচের মাটি ক্ষয়ে গেছে। এগুলো ঠিক করার জন্য আলাদা টিম কাজ করবে। মূল প্রকল্পের সঙ্গে এটি সম্পৃক্ত নয়। প্রকল্পের কাজও চলবে আবার একইসঙ্গে মেরামতও চলবে। সুতরাং যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

তিনি আরও বলেন, রেললাইনে বন্যা হবে এটি স্বাভাবিক বিষয়। সিলেট অঞ্চলে প্রায় সময় বন্যা হয়। ওই রোডে ট্রেন চলে না? তাছাড়া কক্সবাজার অংশে জলোচ্ছ্বাস হবে এই চিন্তা থেকে রেললাইন এমনিতে উঁচু করা হয়েছে। এটি মাটি থেকে প্রায় ২০ ফুট উঁচু। তবে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া অংশে এবার পাহাড়ি ঢল নেমেছে। এরকম পানি স্বরণকালে হয়নি। প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডির সময় অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন যেহেতু এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে প্রয়োজনে রেললাইনের বিশেষ অংশ আরও উঁচু হবে।

এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, রেললাইনে পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রকল্প পরিচালক। তিনি জানান, যদি এমন হতো তাহলে রেললাইনের একপাশে পানি থাকত অন্যপাশে তো থাকত না। কিন্তু এখন রেললাইনের দুপাশেই পানি রয়েছে।

জানা গেছে, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ২০১০ সালের ৬ জুলাই একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০১৮ সালে ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালের ৩০ জুনে। পরে এক দফা বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ করা হয় ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এতে ব্যয় ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও ব্যয় বাড়েনি। রেলপথটি নির্মিত হলে মিয়ানমার, চীনসহ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের করিডোরে যুক্ত হবে বাংলাদেশ।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • শনিবার (সকাল ১১:০৭)
  • ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি
  • ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (বর্ষাকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com