একাত্তরের ‘বীরাঙ্গনা’ মায়ের খোঁজ চান তারা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন হাজার হাজার নারী। সেই সময় জন্ম নেওয়া শিশুদের অনেককে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন তাদের অনেকেই শেকড়ের সন্ধান করছেন।

জেন রাদিকা তাদেরই একজন। যিনি পরিবারকে খুঁজছেন।  কিছু প্রশ্নের জবাব চান তিনি। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি রাদিকার। বাংলাদেশের একটি এতিমখানা থেকে ইংল্যান্ডের ছোট্ট শহর কোর্নিশের এক দম্পতির দত্তক নেওয়ার গল্প জানতে চান তিনি। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান জেন রাদিকার পরিবারের খোঁজে হন্যে হয়ে ফেরার গল্প তুলে ধরে এক প্রতিবেদনে।

এতে বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালের এক গ্রীষ্মে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ বয়সে ঢাকা থেকে ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জেনকে। দেশটির এক ছোট্ট শহরে মাইক কিং ও তার স্ত্রীর যত্নে বড় হন তিনি। নিজেকে বুঝতে শেখার পর থেকে অবশ্য জেনকে বার বার পিছু ডেকেছে তার অতীত। ডাক এড়াতে পারেননি, শুরু করেছেন অন্বেষণ।

জেন জেনেছেন, তার মতো আরও অনেক মানুষ ছড়িয়ে রয়েছেন সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও কানাডার মতো বিদেশ-বিভুঁইয়ে। যারা সকলে ‘বীরাঙ্গনা’র সন্তান।

ইতিহাসবিদদের অনেকেই বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটির মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে এক রক্তঝরা ইতিহাস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। তার ঠিক আগের ৯ মাস ধরে ঢাকা, খুলনা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশালসহ অনেক জেলা দিয়ে বয়ে যায় রক্তস্রোত। অন্তত ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোষররা। সেই সঙ্গে চলে নির্বিচার ধর্ষণ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন হেনস্থাকে কার্যত অস্ত্র বানিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। লাখ লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। তাদের অনেকে প্রাণ হারিয়েছিলেন, অনেকের গর্ভে ছিল সন্তান। পাক সৈন্যদের ধর্ষণে প্রায় ২৫ হাজার নারী গর্ভধারণ করেন।

যুদ্ধ শেষে স্বাধীন হল বাংলাদেশ। কিন্তু এই নারীদের কী হবে? জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের ‘বীরাঙ্গনা’ সম্মানে ভূষিত করেন। আর অনাথ শিশুদের দায়িত্ব নেয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। তাদের দত্তকের জন্য আন্তর্জাতিক প্রচারণাও শুরু হয়। ব্রিটিশ ওই দৈনিক বলছে, সেই সূত্রেই মাইক কিং বুকে তুলে নিয়েছিলেন জেনকে। ১৯৭২ সালে প্রথম যে শিশুদের দত্তক নেওয়া হয়, জেন ছিলেন তাদেরই একজন।

জেন বলেছেন, ‘আমি শুধু জানি, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার মা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। একটা সময়ে ভাবতাম, যখন থেকে আমাকে দত্তক নেওয়া হয়, তখন থেকেই আমার জীবনের শুরু। এখন জানি সেটা ভুল। বাংলাদেশেও আমার জীবনের অংশ রয়েছে।’

বাংলাদেশের যে এতিমখানা থেকে তাকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল, সেখানকার খাতায় তার নাম হিসেবে রাদিকা লেখা থাকলেও, তার মায়ের নাম নেই। বাড়ির ঠিকানা হিসেবে লেখা রয়েছে, ‘উইমেন রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম।’ জেনের আফসোস, কখনই হয়তো জন্মদাত্রীকে খুঁজে পাবেন না তিনি।

গার্ডিয়ান বলছে, যুদ্ধের পরে অন্তত পাঁচ হাজার শিশুর জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এরচেয়েও বেশি হতে পারে। এতিমখানার প্রতিনিধিরা সেই সময়ে শহরের রাস্তা থেকে তুলে আনে বহু সদ্যোজাত শিশুকে। হাসপাতাল, ক্লিনিকে গিয়ে মায়েদের অনুরোধ করেছেন সন্তানের জন্মের পর তাদের হাতে তুলে দিতে। অনেক মায়ের গর্ভপাতের সংস্থান না থাকায় নিজে নিজে চেষ্টা করতেন। ফলে প্রাণহানিও ঘটেছে অনেক।

শিখা কাপুচিনোর গল্পটাই যেমন খানিকটা এ রকম। গর্ভপাতের ব্যর্থ চেষ্টার পর সাত মাসে জন্ম হয় শিখার। মায়ের পরিচয় তিনি জানেন না এখনও। ঢাকার এতিমখানা থেকে তাকে দত্তক নেন কানাডার ফ্রেড ও বনি কাপুচিনো।

দু’বছর আগে নিজের মায়ের খোঁজ শুরু করেছিলেন জেন। তিনি সেই খোঁজ থেকেই পৌঁছান ঢাকার তেজগাঁওয়ে। যেখানে কয়েক জন ‘বীরাঙ্গনা’র বাড়ি। সন্তানস্নেহে জেনকে বুকে টেনে নিয়েছেন তারা। জেন বলেন, তাদের মধ্যে আমার মায়ের ছোঁয়া রয়েছে। বাংলাদেশ ও আমি প্রায় একই সময়ে তৈরি হয়েছি। এই সত্যের কখনও পরিবর্তন হবে না।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • শনিবার (বিকাল ৩:৫০)
  • ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি
  • ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (বর্ষাকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com