দৈনন্দিন খাদ্যাভাসে পোকামাকড় যুক্ত করতে চান যে শেফ

কারো যদি প্রতিদিন মাছ-মাংস খেতে একঘেয়ে লাগে, কিংবা আমিষের ভিন্ন কোনো উপাদান সম্পর্কে যারা আগ্রহী— তারা স্বচ্ছন্দে জোসেফ ইউনের রেস্তোরাঁ ব্রুকলিন বাগসে ঢুঁ দিতে পারেন। নিউইয়র্কের এই রেস্তোরাঁটিতে ঝিঁঝি পোকা, মাকড়শা কাঁকড়া বিছাসহ খাদ্যযোগ্য বিভিন্ন পোকামাকড়ের নানা ডিশ নিয়মিতই পাওয়া যায়।

মার্কিন সংস্থা ব্রুকলিন বাগস খাদ্যযোগ্য বিভিন্ন পোকামাকড়কে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে থাকে। চার বছর আগে নিউইয়র্কের ব্রুকলিন শহর থেকে যাত্রা শুরু করে সংস্থাটি। শুরু থেকেই ব্রুকলিন বাগসের নির্বাহী পরিচালকের পদে রয়েছেন জোসেফ ইউন।

ইউনের রেস্তোরাঁটি সেই সংস্থাটিরই একটি প্রকল্প, তাই সেটির নামও রাখা হয়েছে সংস্থার নামেই।

পেশাগত জীবনে একজন শেফ জোসেফ ইউন মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, ‘আমি পোকামাকড় খুবই ভালবাসি এবং তার অনেক কারণও রয়েছে। প্রথমত, বিশ্বজুড়ে প্রচুর প্রজাতির পোকামাকড় রয়েছে এবং সেসবের সংখ্যাও প্রচুর। দ্বিতীয়ত, প্রকৃতির ভারসাম্যের জন্য আমরা তাদের ওপর নির্ভরশীল এবং তৃতীয়ত, পোকামাকড় ব্যতীত বিশ্বের খাদ্য-শৃঙ্খল ভেঙে পড়বে।’ইউন বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে খাদ্যযোগ্য পোকামাকড়ের প্রজাতির সংখ্যা ২ হাজার ১০০টিরও বেশি এবং সেগুলোর স্বাদও বিভিন্ন। ব্রুকলিন বাগস চায় এই প্রাচুর্যভরা আমিষ ও খাদ্যপ্রাণের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিতে। আমাদের যাবতীয় কার্যক্রমের উদ্দেশ্য এটাই।’নির্ভরযোগ্য আমিষের উৎসজাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (ফাও) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান বিশ্বের অন্তত ২০০ কোটি মানুষ খাদ্য হিসেবে পোকামাকড় নিয়মিত গ্রহণ করেন

এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয়তা পেলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এখনও খাদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি পোকামাকড়।

এদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একদিকে যেমন জমির পরিমাণ কমছে, তেমনি দিন দিন ঝুঁকি বাড়ছে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাতেও। ফাও’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী ২০৫০ সালের দিকে বিশ্বের জনসংখ্যা উন্নীত হবে ৯০০ কোটিতে এবং এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য বর্তমানের তুলনায় খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ করতে হবে দ্বিগুণ।

অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন করতে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিবেশও। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতিদিন যে পরিমাণ গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গত হয়, তার ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ আসে বিভিন্ন পশু-পাখির খামার থেকে।

এই গ্রীনহাউস গ্যাসগুলো মূলত বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে আবহাওয়াগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, তার প্রধান কারণ অতিমাত্রায় গ্রীনহাউস গ্যাসের নিঃস্বরণ।

ফাওয়ের প্রতিবেদন অনুসারে, একটি মাঝারি আাকারের গরুর খামারে গরুর খাবার বাবদ যে পরিমাণ ব্যয় হয়, একটি ঝিঁঝিঁ পোকার খামারের খাদ্য বাবদ ব্যয় তার চেয়ে অন্তত ৬ গুণ কম, কিন্তু এক বাটি গরু, ভেড়া, শূকর ও ব্রয়লার মুরগির মাংস থেকে থেকে যে আমিষ মেলে; সেই একই বা তারচেয়ে কিছু বেশি আমিষ পাওয়া যায় এক বাটি ঝিঁঝিঁ পোকা থেকে।

এবং আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো— গরু, ছাগল, ভেড়া, শূকরের মাংসে কোলেস্টরেলসহ ক্ষতিকর নানা উপাদান থাকে, হাঁস-মুরগির খামারে বার্ডফ্লু বা এই জাতীয় রোগের বিস্তারের আশঙ্কা থাকে; কিন্তু ঝিঁঝি পোকার এই সমস্যা নেই। এক বাটি ঝিঁঝিঁ পোকা থেকে যে আমিষ মেলে তা চর্বিমুক্ত বিশুদ্ধ আমিষ।

ঝিঁঝি পোকা

যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দাদেরকে খাদ্যযোগ্য পোকামাকড়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন প্যাট্রিক ক্রাওলি নামের উদ্যোক্তা। ২০১২ সাল থেকে ঝিঁঝিঁ পোকা থেকে তৈরি করা বিভিন্ন খাদ্য আইটেম এবং প্রোটিন পাউডার বিক্রি করছেন তিনি।

২০১৪ সাল থেকে কানাডাতেও পোকামাকড়ভিত্তিক বিভিন্ন রেস্তোরাঁ গড়ে উঠতে থাকতে। ইতোমধ্যে দেশটিতে ‘নামের পোকামাকড় চাষের খামারও গড়ে উঠেছে। নেক্সট মিলেনিয়াম’স ফার্ম নামের সেই খামারটিতে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিকভাবে খাদ্যযোগ্য বিভিন্ন পোকামাকড়ের চাষও হচ্ছে।

খাবারযোগ্য পোকামাকড়ের প্রচার-প্রচারণা চালানো আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাটফরম অব ইনসেক্টস ফর ফুড অ্যান্ড ফিডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অন্তত ৯০ লাখ মানুষ খাবারযোগ্য পোকামাকড়ের স্বাদ নিয়েছেন। ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৩৯ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছে সংস্থাটি।

‘যখন আপনি পোকামাকড়ের ব্যাপারে ভাববেন— একটা পোকা কিংবা একজন মানুষ কি পৃথিবীতে বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারে? আমার উত্তর হলো— পারে। গত চার বছর ধরে যে আমি প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি, তার প্রধান কারণ আমি বিশ্বাস করি— প্রতিটি ‍মানুষেরই সমাজ ও পৃথিবীর প্রতি দায়িত্ব রয়েছে।’

‘আপনি যদি সপ্তাহে একদিন মাছ-মাংস বাদ দিয়ে পোকা-মাকড় খান, তাহলে বৈশ্বিক খাদ্যচক্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে,’ সিএনএনকে বলেন ইউন।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • শনিবার (সকাল ১১:৪৩)
  • ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি
  • ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (বর্ষাকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com