মানুষের স্বাভাবিক স্বভাব হলো ছোট ও অল্প জিনিসকে গুরুত্ব না দেওয়া। তবে নেক আমল যত অল্পই হোক না কেন, তার প্রতি উদাসীনতা কাম্য নয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,
فَمَنْ یَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَیْرًا یَّرَهٗ، وَ مَنْ یَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا یَّرَهٗ
কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে সে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে সে তা-ও দেখবে। -(সূরা যিলযাল (৯৯), আয়াত, ৭-৮)
আয়াতে কিয়ামতের ময়দানের কথা এখানে বলা হয়েছে। দুনিয়াতে ছোট-বড় যে কাজই মানুষ করুক, তা পাপের হোক আর পুণ্যের হোক, গোপনে হোক কিংবা প্রকাশ্যে, নিজ নিজ আমলনামায় মানুষ সেদিন সবকিছুই দেখতে পাবে।
বড় বড় পাপ কিংবা পুণ্যের সাধারণ হিসাব তো মানুষের থাকে। কিন্তু ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর এমন অনেক কিছুই সেদিন আমলনামায় মানুষ দেখতে পাবে- যার প্রকাশ সে কল্পনাও করতে পারেনি। আমলনামার এ ব্যাপকতা দেখে মানুষের চোখমুখ থেকে তখন ঝরতে থাকবে বিস্ময়। বিশেষত যারা অপরাধী, পাপ ও অন্যায় যাদের বেশি, নিজেদের কৃতকর্মের এমন ধারণাতীত সংরক্ষণ দেখে তাদের মুখে উচ্চারিত হবে হতাশার সুর।
কোরআনের ভাষায়-
وَ وُضِعَ الْكِتٰبُ فَتَرَی الْمُجْرِمِیْنَ مُشْفِقِیْنَ مِمَّا فِیْهِ وَ یَقُوْلُوْنَ یٰوَیْلَتَنَا مَالِ هٰذَا الْكِتٰبِ لَا یُغَادِرُ صَغِیْرَةً وَّ لَا كَبِیْرَةً اِلَّاۤ اَحْصٰىهَا، وَ وَجَدُوْا مَا عَمِلُوْا حَاضِرًا، وَ لَا یَظْلِمُ رَبُّكَ اَحَدًا
এবং আমলনামা উপস্থিত করা হবে। এতে যা লিপিবদ্ধ আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে আতঙ্কগ্রস্ত এবং তারা বলবে- ‘হায়! দুর্ভাগ্য আমাদের! এটা কেমন গ্রন্থ! এ তো ছোট-বড় কোনোকিছুই বাদ দেয় না, বরং তা সবকিছুরই হিসাব রেখেছে।’ তারা তাদের কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। তোমার প্রতিপালক কারও প্রতি জুলুম করেন না। -(সূরা কাহফ (১৮), আয়াত, ৪৯)
এখানে শুধু অপরাধীদের কথা বলা হয়েছে। আর সূরা যিলযালের উপরোক্ত আয়াতদুটিতে বলা হয়েছে ছোট ছোট পাপ-পুণ্য উভয়ের কথা। আর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনও ভালো কাজকেও তুচ্ছ মনে করতে নিষেধ করেছেন। বর্ণিত হয়েছে,
‘ভালো কোনো কাজকেই তুচ্ছ মনে করবে না। সে কাজটি কাউকে এক টুকরো রশি দিয়ে সহযোগিতা করে হোক, কাউকে একটি জুতার ফিতা দিয়ে হোক, তোমার পানির পাত্র থেকে পানিপ্রত্যাশী কারও পাত্রে সামান্য পানি ঢেলে দিয়ে হোক, মানুষের চলার পথ থেকে কষ্টদায়ক কোনোকিছু সরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে হোক, হাসিমুখে তোমার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে হোক, তোমার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সালাম দিয়ে হোক, পৃথিবীতে কোথাও কারও একাকীত্ব দূর করে দিয়ে হোক- কোনো কিছুকেই তুমি তুচ্ছ মনে করবে না। তোমার কোনো অন্যায়ের কথা জেনে কেউ যদি তোমাকে গালি দেয় আর তুমি জান- তার মধ্যেও এ দোষটি রয়েছে, তখন তুমি তাকে গালি দেবে না; এতে তার প্রতিদান তুমি পেয়ে যাবে, আর তার গগুনাহ তার কাঁধেই থাকবে। -(মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ১৫৯৫৫)
আরেক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
তুচ্ছ মনে করা হয়- এমন সকল পাপ থেকে তোমরা বেঁচে থেকো। তুচ্ছ এসব পাপের দৃষ্টান্ত তো এমন- যেমন কিছু মানুষ একটি উপত্যকায় যাত্রাবিরতি করল। তখন তাদের একজন একটি লাকড়ি নিয়ে এল। আরেকজন আরেকটি লাকড়ি নিয়ে এল। এভাবে তাদের এ পরিমাণ লাকড়ি সংগ্রহ হয়ে গেল, যার আগুন দিয়ে তারা তাদের রুটি সেঁকে নিতে পারে। সন্দেহ নেই, এ তুচ্ছ পাপগুলোতে যখন কেউ লিপ্ত হয় সেগুলো তাকে তখন ধ্বংস করে দেয়। -(আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৫৮৭২; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ১৭৪৬২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৮০৮)
ছোট ছোট পুণ্য আর তুচ্ছ পাপ নিয়ে এই হল হাদীসের নির্দেশনা। পবিত্র কোরআনের ভাষ্যে বলা হয়েছে মানুষের আমলনামায় ছোট-বড় সব আমলই সংরক্ষিত থাকবে এবং কিয়ামতের দিন এসব আমলেরই হিসাব হবে।
দুনিয়ার ভালোমন্দ কাজের ফল আমাদেরকে ভোগ করতে হবে আখেরাতে। কাজ ভালো হোক আর মন্দ, ভালো কাজ করা আর মন্দ থেকে বাঁচা বা মন্দ থেকে আল্লাহর ক্ষমা লাভ করা- তা করে যেতে হবে এ দুনিয়াতেই। আখেরাতে নতুন করে আমল করার কোনো সুযোগ থাকবে না। দুনিয়ার অর্থবিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তিও কোনো কাজে আসবে না। কাজে লাগবে একমাত্রই দুনিয়ার আমল। কারও কোনো দেনা শোধ করতে হলেও তা আমলের বিনিময়েই করতে হবে। পরকালীন এ বাস্তবতাকে সামনে রাখলেও সহজে বুঝে আসে- ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমলকে তাচ্ছিল্য না করার বিষয়টি।