আজিজুলের মদকাণ্ডে এখন ‘বিব্রত’ আওয়ামী লীগের নেতারা

কয়েক দিন ধরেই সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম মুন্সীগঞ্জের ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম; আর তা মিথ্যা ঘোষণায় বিপুল পরিমাণ মদ আমদানি নিয়ে।

“তার মদ পাচারের যোগসাজশের বিষয়ে আমরা সবাই বিব্রত,” এক কথায় বললেন মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ঘোলঘর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুবুর রহমান রুনু।

তার মতোই এলাকার আরও অনেক আওয়ামী লীগ নেতার অস্বস্তি সেই ইউনিয়নেরই চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলামকে নিয়ে, যিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে গত বছরই দ্বিতীয়বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

গত কয়েক দিন ধরেই সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম আজিজুল; আর তা মিথ্যা ঘোষণায় বিপুল পরিমাণ মদ আমদানি নিয়ে।

গত শনিবার দুই কন্টেইনার ভরতি ৩৬ হাজার ৮১৭ বোতল বিদেশি মদ উদ্ধারের পর এই চোরাচালানের ‘হোতা’ হিসেবে আজিজুলকেই চিহ্নিত করেছে র‌্যাব।

৫৭ বছর বয়সী ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যই শুধু নন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক উপকমিটিরও সদস্য। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতেও চাইছিলেন তিনি।

এলাকায় কথা বলে জানা যায়, গত শনিবার দুপুরে ষোলঘর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় ছিলেন আজিজুল। সভা শেষ হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসেন।

এরপর র‌্যাবের অভিযানে মদ উদ্ধারের খবর যখন সংবাদ মাধ্যমে আসে, ততক্ষণে আজিজুল তার বড় ছেলেকে নিয়ে বিদেশে পালিয়েছেন। তবে তার মেজ ছেলে ধরা পড়েছেন বিমানবন্দরে।

চেয়ারম্যান কিংবা আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে যাকে চিনতেন, তার মদ চোরাচালানে সংশ্লিষ্টতার খবর শুনে এলাকাবাসী এখন বিস্মিত।

এখন আজিজুলের বাড়ি ও মদ রাখার অয়্যারহাউজ দেখতে যাচ্ছেন অনেকেই। রিকশা পার্টসের ব্যবসা থেকে আজিজুল কীভাবে বিত্তশালী, সেই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন, এই প্রশ্ন যাদের ছিল, তারা এখন উত্তর পাচ্ছেন বলে মনে করছেন।

ষোলঘর ইউনিয়ন পরিষদের ওয়েবসাইটে আজিজুলের জীবনীতে বলা আছে- “ব্যবসা ও অন্যান্য কারণে খুব একট লেখা-পড়ার সুযোগ না হলেও তিনি এইচএসসি শেষ করে ব্যবসা ও সমাজ সেবামূলক কাজে বিশেষ মনোযোগ দেন।

“তিনি কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। জনাব আলহাজ্ব মো. আজিজুল ইসলাম সাহেব ন্যায় পথে চলেন । তিনি চেয়ারম্যান হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত গরীব, দুঃখী, মেহনতি মানুষের পাশে ছিলেন।”

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলেন, আওয়ামী লীগ এই দফায় ক্ষমতায় আসার আগে আজিজুলকে দলে দেখা যায়নি। এক দশক আগে আওয়ামী লীগে ঢুকে চেয়ারম্যান হওয়ার পাশাপাশি দলে একের পর এক পদ বাগিয়ে নেন তিনি।

এখন শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য বেশ চেষ্টা যে তিনি চালাচ্ছেন, তা দেখা যায় উপজেলাজুড়ে তার নামে ব্যানার-ফেস্টুন, পোস্টারে।

এক দশক আগে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য যখন সুকুমার রঞ্জন ঘোষ, তখনই আজিজুলের উত্থান।

এখন নানা অভিযোগের বিষয়ে ঘোলঘর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহাবুবুর রহমান রুনু বলেন, আজিজুলে সঙ্গে তার ‘রাজনৈতিক সম্পর্ক ভালো’, তবে তার ব্যবসার বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না।

মুন্সীগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদের কাছে সোমবার রাতে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “আমি তো এখন কিছু বলতে পারব না, একটা জনসভায় আছি।”

শ্রীনগরের এক ইউনিয়ন থেকে আজিজুলের কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ-কমিটিতে আসার ক্ষেত্রে এই উপকমিটির চেয়ারম্যান গোলাম মওলা নকশবন্দীর হাত দেখছেন উপকমিটির সদস্য সচিব সিরাজুল মোস্তফা।

তিনি বলেন, এ ঘটনার পর তাকে অনেকেই ফোন করছেন। ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির নাম এভাবে ‘কলঙ্কিত’ হওয়ায় তিনি খুবই দুঃখ পাচ্ছেন।

সিরাজুল মোস্তফা বলেন, “আমি শুনেছি, আজিজুল গোলাম মওলার লোক। তিনিই এই ধরনের কিছু লোককে উপ-কমিটিতে ঢুকিয়েছেন, যারা আমাদের এই উপ-কমিটির নাম কলঙ্কিত করেছে। এখন আমি এটুকুই বলতে পারি যে আজিজুলের বিরুদ্ধে সংগঠনের বিধি অনুযায়ী ব্যব্স্থা নেওয়া হবে।”

সিরাজুল মোস্তফার এই অভিযোগ প্রসঙ্গে উপকমিটির চেয়ারম্যান গোলাম মওলা নকশবন্দী বলেন, “কমিটিতে উনারও (সিরাজুল মোস্তফার) লোক আছে, আমারও লোক আছে। এ বিষয়ে আমার বলার কিছু নাই। তদন্ত হোক, তদন্তের পর সব বলা যাবে।”

আজিজুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না- প্রশ্নে তিনি বলেন, “অভিযোগ আসতেই পারে। কত রকমের অভিযোগই তো ওঠে। ছেলের দোষে তো আর বাপ দোষী হতে পারে না। তবে অভিযোগ যদি প্রমাণিত হয়, তিনি কনভিক্টেট হলে কমিটি থেকে তিনি বরখাস্ত হয়ে যাবেন।”

এখন আজিজুলের বিরুদ্ধে পেটোয়া বাহিনী লালন, ভূমি দখলের অভিযোগও উঠছে। তার এক ভাই প্রকাশ্যে শটগান নিয়ে চলেন, এমন কথাও বলছেন স্থানীয়রা।

তবে শ্রীনগর থানার ওসি আমিনুল ইসলাম  বলেন, আজিজুল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা নেই। আগের কোনো অভিযোগের বিষয়েও তার কাছে তথ্য নেই।

শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর-বীরতারা রাস্তার পাশে প্রায় এক একর জমির উপর আজিজুলের গুদাম। এটাকেই র‌্যাব বলছে ওয়্যারহাউজ।

স্থানীয়রা বলছেন, এখানে প্রায়ই রাতের বেলা কন্টেইনার আসত। গাড়িগুলোকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রেখেই শতশত কার্টন ওঠানো-নামানো হত। তবে তারা ভাবতেন এগুলো ইলেকট্রিকাল কিংবা ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম।

স্থানীয় ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি শহীদুল ইসলাম জানান, গুদামে কভার্ডভ্যান ঢুকতে পারত না। সেজন্য দুদিন আগেই আজিজুল গুদামের বাইরের একপাশের দেওয়াল ভেঙে কভার্ডভ্যান ও লম্বা ট্রেইলার ঢোকার ব্যবস্থা করেন।

মদের চালান উদ্ধারের পর র‌্যাবের মুখপাত্র কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের বলেন, “আজিজুলের চীনা বৈদ্যুতিক রিক্শা আমদানির ব্যবসা এবং তার ছেলেদের ইলেকট্রনিক্স আমদানির ব্যবসা রয়েছে বলে গ্রেপ্তার হওয়া আজিজুলের ছেলে আব্দুল আহাদ জানিয়েছেন।”

মুন্সীগঞ্জের পর ঢাকার ওয়ারিতে আজিজুলের ১২ তলা ভবনেও তল্লাশি চালায় র‌্যাব। সেখানে ৯৮ লাখ বাংলাদেশি টাকাসহ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়ার কথাও জানানো হয়।

স্থানীয়রা জানায়, কৃষক পরিবারের সন্তান আজিজুল ঢাকার বংশালের একটি রিকশা পার্টসের দোকানে চাকরি করতেন। এরপর নিজে দোকান দিয়ে শুরু করেন একই ব্যবসা। সেখান থেকেই তার উত্থান।

মদসহ গ্রেপ্তার আজিজুলের কর্মী নাজমুল মোল্লার বাড়িও ষোলঘর ইউনিয়নে। সোমবার তার বাড়িতে গিয়ে তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।

অন্যদিকে আজিজুলের নতুন বাড়ি ‘মায়ের স্বপ্ন গোল্ডেন গার্ডেনে’ গিয়েও তার পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। তার স্ত্রী মায়া ইসলামসহ আরেক ছেলে কোথায় আছে, তাও কেউ বলতে পারছে না।

এলাকায় আলিশান বাড়ি, প্রচুর জমি, গুদামের পাশপাশি ঢাকার ওয়ারিতে বাড়ি ছাড়াও বংশালে আজিজুলের গুদাম রয়েছে।

আজিজুল ও তার ছেলেরা প্রায়ই দুবাই যাতায়াত করেন বলে র‌্যাব জানতে পেরেছে।

মদের এই চালান দুবাই থেকে আনা হয়েছিল জানিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তা আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া আহাদ তাদের বলেছেন, দুবাইয়ে একটি হোটেলে অবস্থানরত নাসির উদ্দীন এই চালানগুলো ঢাকায় পাঠাচ্ছেন। তার বাড়িও মুন্সীগঞ্জে।

আজিজুলের অয়্যারহাউজ থেকে মদ আটকের পর তা ছেড়ে দিতে নানা তদবিরও হয়েছিল বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

আল মঈন বলেন, মদভর্তি কন্টেইনার জব্দ করার পর সেখানে একটি ফোন নম্বর পাওয়া যায়। ওই নম্বরধারী ব্যক্তির কাছেই মদগুলো ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। ওই নম্বরে ফোন করা হলে নানা পরিচয় দিয়ে মালগুলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলে। সেটা হবে না বুঝতে পারার পরপরই নম্বরটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অভিযানে থাকা র‌্যাব-১১ এর একজন কর্মকর্তা বলেন, “কনটেইনারের সাথে যে দুজন ছিলেন, তাদের কাছ থেকে মালিকপক্ষের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে ফোন দিলে তারা নানাভাবে কনভিন্স করার চেষ্টা করে। কোনোভাবে কনটেইনার দুটো ছেড়ে দেওয়া যায় কি না, সেই তদবিরও করতে থাকে। রাজনৈতিক পরিচয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন মহলের নাম করে তদবির

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • রবিবার (সকাল ৮:৩২)
  • ১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১১ই জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি
  • ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com