দুর্গম দ্বীপ কুতুবদিয়ায় বিদ্যুতের আলোয় নানা সুবিধার পাশাপাশি জীবনে প্রথম আইসক্রিম দেখেছে অনেকে। প্রসূতি মায়েদের এখন আর ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিতে হয় না, সিজারিয়ান ডেলিভারি হয় উপজেলা হাসপাতালেই।
দুই মাস আগে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলায় জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর পর সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রায় নানা পরির্বতন এসেছে। তাছাড়া এলাকার আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি থেকে মগনামা ঘাট পর্যন্ত ৩৩ কেভি রিভার ক্রসিং লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে সাগরের তলদেশে ফাইবার অপটিকসহ পাঁচ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সাবমেরিন লাইন নির্মাণের মাধ্যমে কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ দিতে কুতুবদিয়ায় নির্মিত হয়েছে দুই কিলোমিটার বিতরণ লাইন
দেশব্যাপী শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে ২০২০ সালে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ নির্ভরযোগ্য ও টেকসই বিদ্যুতায়ন’ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ রয়েছে। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন কুতুবদিয়া দ্বীপে স্বাভাবিক লাইন নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো সুযোগ না থাকায় সাবমেরিন ক্যাবল ব্যবহার করা হয়েছে। এটি ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে উদ্যোগ নেয় সরকার।
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি থেকে মগনামা ঘাট পর্যন্ত ৩৩ কেভি রিভার ক্রসিং লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। সেখান থেকে সাগরের তলদেশে ফাইবার অপটিকসহ পাঁচ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সাবমেরিন লাইন নির্মাণের মাধ্যমে কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ দিতে কুতুবদিয়ায় নির্মিত হয়েছে দুই কিলোমিটার বিতরণ লাইন।
দ্বীপটির প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বর্তমানে প্রায় ২ লাখ মানুষ বসবাস করেন। এখানে ১৯৮০ সালে জেনারেটরের মাধ্যমে প্রায় ৬০০ গ্রাহকের মধ্যে সান্ধ্যকালীন কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থা চালু করা হয়। তবে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে যাওয়ায় সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন সময় স্বল্প আকারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পিডিবি।
শত বছরের কুতুবদিয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার মান সমৃদ্ধ হলেও বিদ্যুৎ না থাকায় সামগ্রিক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত ছিল। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও এখানকার মানুষের কথা ভাবেনি কোনো সরকার। বর্তমানে বিদ্যুৎ থাকায় এখানকার মানুষের জীবনমান বদলে গেছে। সর্বক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। কুতুবদিয়ার মানুষের কাছে বিদ্যুৎ একসময় স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন এখন বাস্তব। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের আলোয় রাতেও ঝলমল করছে কুতুবদিয়ার রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়িসহ বড়ঘোপ বাজার।
কুতুবদিয়া উপজেলার বড়ঘোপ বাজারের ব্যবসায়ী জিল্লুর করিম জানান, কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ আসবে, এটা অকল্পনীয় ছিল। কুতুবদিয়ার মানুষের স্বপ্ন পূরণে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক ছিলেন। ১২ এপ্রিল রাত থেকে আমরা বিদ্যুৎ পেয়েছি। আমি মনে করি, বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়ে চট্টগ্রাম শহরের মতো এখানে শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে।
বড়ঘোপ বাজারে মুদি দোকান রয়েছে মো. আজিজ মিয়ার। তিনি চাল, চাল, আটা, ময়দাসহ নিত্যপণ্য বিক্রি করেন। দীর্ঘদিন ডিপ ফ্রিজে ছয় ঘণ্টা ঠান্ডা করে কোমলপানীয় বিক্রি করলেও কোনো দিন আইসক্রিম বিক্রি করেননি এই ব্যবসায়ীসহ উপজেলার ব্যবসায়ীরা। সমুদ্র পার হলেই কেবল আইসক্রিম খাওয়ার সুযোগ মিলত কুতুবদিয়ার বাসিন্দাদের। বর্তমান সরকার সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে এই দ্বীপে। এতে আজিজের মতো মুদি ব্যবসায়ীর কপাল খুলেছে।
মো. আজিজ বলেন, গত তিন মাস ধরে আইসক্রিম বিক্রি করছি। বিদ্যুৎ আসার সঙ্গে সঙ্গে সেবয় আইসক্রিম কোম্পানি আমাদেরকে ফ্রিজ দেয়। যে দিন আইসক্রিম বিক্রি শুরু করেছি, সে দিন ১৭ হাজার টাকার বিক্রি হয়। এখন দৈনিক সাত-আট হাজার টাকার আইসক্রিম বিক্রি হয়।
তিনি বলেন, আগে জেনারেটরের বিদ্যুৎ দিয়ে ডিপ ফ্রিজে স্পিড, টাইগার, কোকাকোলা, সেভেন আপ বিক্রি করতাম। কারণ ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল। সন্ধ্যা ৬টায় দিলে রাত ১১টা বা ১২টা পর্যন্ত থাকত। এখন ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। আইসক্রিম বিক্রি করায় আমাদের ভাগ্য ঘুরেছে।
কুতুবদিয়ার বড়ঘোপের চান্দের গাড়ির চালক নুরুল কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই মাস হলো বিদ্যুৎ এসেছে। আমার ঘরে বিদ্যুৎ যায়নি, তবে বৈদ্যুতিক খুঁটি দেওয়া হয়েছে। আমার ঘরে বৈদ্যুতিক তার লাগানো হয়েছে। এত দিন সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে লাইট জ্বলত।