আজ শ্যামারচর-পেরুয়া গণহত্যা দিবস

১৯৭১’র ৪ ডিসেম্বর ভোররাত। ওই সময় থেকেই শাল্লা উপজেলার দৌলতপুরের পাকিস্তানি বাহিনীর দালাল আব্দুল খালেকের নেতৃত্বে শ্যামারচর, পেরুয়া, উজানগাঁও, দৌলতপুরসহ কয়েকটি গ্রামে অতর্কিতে হামলা চালায় রাজাকাররা।

পেরুয়া গ্রামের ২৬ জনকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করে ব্রাশ ফায়ারে হত্যার আগে নিজ গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাতজনকে হত্যা করে খালেক বাহিনী। ক্যাম্পে ও বাঙ্কারে নারীদের ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানো। ইতিহাসে এটি পেরুয়া-শ্যামারচর গণহত্যা হিসেবে পরিচিত।

হাওরাঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটিই ইতিহাসের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৮ বছর অতিবাহিত হলেও আজো এখানে স্মৃতিচিহ্ন গড়ে ওঠেনি। এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা গণহত্যাস্থলে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, দালাল খালেক অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল এলাকায়। সত্তরের প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি  পাকিস্তানের পক্ষে যোগ দেন। আধিপত্য থাকায় এলাকার প্রায় তিন  শতাধিক যুববককে রাজাকারদের পক্ষে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। শ্যামারচার বাজারে নিয়ে আসেন পাঞ্জাবিদের। শ্যামারচর পুলিশ ফাঁড়ির অস্ত্র দখল নিয়ে তিনি তার বাড়িকে দুর্গে পরিণত করে। তার নেতৃত্বেই ১৯৭১ সনের ৪ ডিসেম্বর ভোররাতে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নারীনির্যাতনে মেতে ওঠে অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত তিন শতাধিক প্রশিক্ষিত রাজাকার বাহিনী।

নিজ গ্রাম দৌলতপুরের মুক্তিমাঝি মাখন মিয়ার বাড়ি থেকে অভিযান শুরু করেন রাজাকার খালেক। মাখন পরিবারের সাতজনকে হত্যা করা হয় তার নির্দেশে। ধরে নিয়ে যাওয়া হয় মাখন মিয়ার তিন বোনসহ আশপাশের ১০-১২জন নারীকে। পরে ওই বাহিনী নারীদের বাজারের ক্যাম্পে রেখে সুরমা নদী পেরিয়ে পেরুয়া গ্রামে ডুকে অভিযানে নামে। পেরুয়া গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীদের ধরে নিয়ে যায়। লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালায় বাড়িঘরে।

গ্রাম থেকে অন্তত ৩০ জনকে ধরে এনে শ্যামারচার হাইস্কুলের মাঠে কলেমা পড়িয়ে ধর্মান্তরিত করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে খালেক বাহিনীর বিরুদ্ধে। পরে বাজারের গরুহাটে এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে তাদেরকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। বয়সে ছোট থাকায় গুলি মাথার ওপর দিয়ে চলে যাওয়ায় বেঁচে যান পেরুয়া গ্রামের হীরেন্দ্র ও শৈলেন রায়সহ চারজন। গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনদের মধ্যে আখালি দাসকে গুলি করে হত্যা করে তার চোখ দুটি তুলে নেওয়া হয়।

গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ধীরেন্দ্র পুরকায়স্থের বাবা সুখলাল পুরকায়স্থকে শ্যামারচর বাজারে এনে গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করে তার চামড়া ছিলে লবণ ছিটিয়ে বিভৎসভাবে হত্যা করে। এভাবে পৈশাচিক উন্মাদনায় মেতে ওঠে খালেক বাহিনী। স্বাধীনতার পর শহীদদের সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা দালাল খালেককে হত্যা করেন। কিন্তু খালেক ও তার পরিবার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠিত থাকায় এই এলাকার গণহত্যার বিষয়টি ইতিহাসে চাপা পড়ে। ৭৫ সনের পরে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবিপ্লব ঘটে এলাকায়। দীর্ঘদিন রাজাকার খালেকের  পরিবার সদস্য স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত প্রতিনিধি হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন মুঁছে ফেলা হয়।

এলাকাবাসী জানায়, ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের ঢেউ লাগে গ্রামটিতেও। তখনই গ্রামের তরুণ ও মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। ২০১৬ সালে খালেকের ছেলে প্রদীপ, জোবায়েরসহ যোদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরইমধ্যে ছয়জনকে মামলায় গ্রেপ্তার করেছে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। দালাল খালেকের ছেলে যুদ্ধাপরাধী প্রদীপ ও ভাই মুকিত মনির পালিয়ে গেছেন দেশের বাইরে। তবে এখনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে তারা প্রতিষ্ঠিত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পান এলাকাবাসী। ট্রাইব্যুনালের মামলার বাদী ও সাক্ষীদের অনেকেই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।

এদিকে, গণহত্যাস্থলে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবিতে এলাকাবাসী জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু ভূমি নিয়ে আদালতে স্বাধীনতাবিরোধীদের স্বজনরা মামলা করায় স্থাপনা নির্মাণে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। সম্প্রতি খালেক বাহিনীর হাতে নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনারা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।

পেরুয়া গণহত্যা দিবসে শহিদদের স্মরণ করতে আজ বুধবার মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি ও আলোচনাসভার আয়োজন করেছে  মুক্তিযোদ্ধা জনতা।

এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কমরেড অমরচাঁদ দাস বলেন, গণহত্যাস্থলে শহিদ স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য আমরা জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত আবেদনসহ একাধিকবার দেখা করেছি। কিন্তু নির্ধারিত স্থানে মামলা নিয়ে বিরোধ থাকায় স্থাপনা নির্মাণে বিলম্ব হচ্ছে। আমরা এই গণহত্যাস্থলে স্মৃতিস্মারক নির্মাণ চাই।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, গণহত্যাস্থলের জায়গা নিয়ে মামলা চলছে। যার ফলে আমরা কিছু করতে পারছি না। তবে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য প্রশাসন প্রস্তুত।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • মঙ্গলবার (বিকাল ৪:৩৯)
  • ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১৪ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • ১০ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com