বৃষ্টির মৌসুমে চা বাগানগুলো তার পরিপূর্ণ সৌন্দর্য লাভ করে। বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে বৃষ্টির সময় সেখানে ভ্রমণের জন্য উত্তম। চারপাশ তখন আরো সবুজ হয়ে ওঠে, বৃষ্টির জলে সবকিছু খুব সজীব ও প্রানবন্ত রূপ ধারণ করে। তাই চায়ের দেশ ভ্রমণের জন্য বৃষ্টির মৌসুমকেই বেছে নিয়েছিলাম। শ্রীমঙ্গলে গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম থেকে। উদয়ন এক্সপ্রেস চট্টগ্রাম থেকে সিলেট পর্যন্ত যায়। রাত দশটায় ট্রেন ছেড়েছিল, পৌঁছেছিলাম ভোর পাঁচটায়। পরিচিত একজন এসে আমাকে স্বাগত জানালো।
স্টেশন চত্বর থেকেই চায়ের দেশের চা পান করলাম সবার প্রথমে। তখন নরম আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে চারপাশে। স্টেশন থেকে পানসী রেস্টুরেন্টের দূরত্ব খুব বেশি নয়। চা পান করা শেষে আমরা ইঞ্জিনচালিত রিক্সায় চড়ে চলে গেলাম সেখানে। খিচুড়ি আর মাংস দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। খাবারটা বেশ ভালোলেগেছে, দামও ছিল তুলনামূলক কম। হয়তো এজন্যই রেস্টুরেন্টটি এত জনপ্রিয়।
পানসী থেকে আমরা সকালের শীতল আবহাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম বধ্যভূমি ৭১ এ। সকাল ৮ টার আগে সেখানে প্রবেশ করতে দেয় না, তবুও আমরা অনুরোধ করে প্রবেশ করলাম। এত সুন্দর বধ্যভূমি আগে কখনো দেখিনি। বিজিবির অধীনে বিধায় এত পরিপাটি ও সুন্দর। বৃষ্টিস্নাত পরিবেশে আমরা সেখানে ঘুরে বেড়ালাম। সবুজের সমারোহের ভেতর ছোট একটা সরু নদী বয়ে যাচ্ছে সেখানে। নদীটা ছোট হলেও পানিতে বর্ষার জোয়ার টের পাওয়া যাচ্ছিল বেশ। সেখানে খাবারের দোকান ও মনিপুরি শাড়ির দোকানও আছে। শাড়ির দোকানের ভেতর আরো বাহারি কিছু পণ্য রয়েছে। সব মিলিয়ে দেখার ও সময় কাটানোর জন্য শান্ত সুন্দর একটা জায়গা। বধ্যভূমিতে যারা শায়িত আছেন, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি।
বেশ কতক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার আমরা ফিরে আসি পানসি রেস্টুরেন্টে। সেখান থেকে পরিচিত আরো দুজন আমার সাথে যুক্ত হয়। তারপর একজনের বাড়িতে গিয়ে পোশাক বদলে শাড়ি পরে নিই। একটা সিএনজি রিজার্ভ করি। প্রথম গন্তব্য চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, চা জাদুঘর ও লাল পাহাড়। একসময় চা জাদুঘর ও চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে দর্শনার্থীদের প্রবেশ করতে দিত, এখন দেয় না। সেই তথ্য জানা না থাকায় আমরা গেটের কাছ থেকেই ফিরে আসি। লালপাহাড়টা বেশ ভেতরে। সিএনজি মূল রাস্তায় নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে প্রায় ঘণ্টাখানেক হেঁটে পৌঁছাতে হয় লালপাহাড়ে। আমরা পথ খুঁজে খুঁজে যাচ্ছিলাম। এত নীরব নিঝুম চারপাশ, শুধু চা বাগান আর চা বাগান। অনেকটা পথ গিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, যেহেতু আমরা তিনজন মেয়ে আছি কেবল, আর কেউ সাথে নেই, এমন নিরিবিলি পরিবেশে কোনো বিপদ হলেও হতে পারে। তাই কতকটা দূর থেকে লালপাহাড়কে দেখে আমরা ফেরার পথ ধরি নিরাপত্তার কথা ভেবে।
তারপর আমরা অটোতে করে গ্র্যান্ড সুলতান রিসোর্টের কাছে চলে আসি। গ্র্যান্ড সুলতানের পাশেই খাবারের হোটেল আছে। সেখান থেকে আরেক দফায় সকালের নাস্তা সেরে নিই পরোটা, সবজি, ডিমভাজি দিয়ে। এরপর সিএনজি নিয়ে চলে যাই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। জনপ্রতি ৫০ টাকা প্রবেশ মূল্য দিয়ে আমরা ভেতরে প্রবেশ করি। সেখানে অনিন্দ্য সুন্দর এক বনাঞ্চলের দেখা পাই। বনের মাঝ দিয়ে ইট বিছানো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখা মেলে একটা রেলপথের। সেখানে দুটো সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিলো, সাইনবোর্ডে সে ব্যপারে লেখা আছে। আরো কিছুক্ষণ সেখানে থেকে আমরা চলে যাই পরবর্তী গন্তব্যে।আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল মাধবপুর লেক ও রাবার বাগান। শ্রীমঙ্গলে একাধিক রাবার বাগান রয়েছে। মাধবপুর লেকে যাওয়ার পথেই আমরা একটা রাবার বাগানের দেখা পেলাম। সিএনজি থামিয়ে সেখানে অল্প কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করে মাধবপুর লেকের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। মাধবপুর লেকে ঢুকতে কোনো প্রবেশমূল্য নেই, তবে সিএনজি পার্কিং এর জন্য ২০ টাকা দিতে হয়। গেটের কাছে কয়েকটা দোকান আছে। সেখানে মণিপুরি শাড়ি ও বাহারি পণ্য পাওয়া যায়। হাঁটতে হাঁটতে আমরা মাধবপুর লেকে গিয়ে বসলাম। এত অসাধারণ সুন্দর একটা লেক, সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেয়া যায়। চারপাশে পাহাড়, চা বাগান, মাঝখানে লেক, লেকে শাপলা ফোটে। একদম ছবির মতো, কল্পনার মতো ল্যান্ডস্কেপ। আমরা ছোট একটা পাহাড়েও উঠলাম। পাহাড়ের নিচে কয়েকজন চা শ্রমিক দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। আমাকে ডেকে মুখে খাবার তুলে দিলেন পরম স্নেহে। চা পাতা আর চানাচুর দিয়ে তারা এক বিশেষ ভর্তা বানায়, সেই ভর্তা দিয়েই খেলাম কয়েক লোকমা। মাধবপুর লেকের স্মৃতি যতদিন মনে থাকবে, সেই অকৃত্রিম ভালোবাসার কথাও মনে থাকবে।মাধবপুর লেক থেকে আমরা গেলাম কমলগঞ্জ বর্ডারে। সেখানে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের সমাধি রয়েছে। একপাশে বাংলাদেশ, অন্যপাশে ভারত, চারপাশে চা বাগান ও সবুজ ফসলের ক্ষেত। এত সুন্দর একটা জায়গায় হামিদুর রহমান চিরশায়িত আছেন, দেখে মুগ্ধ হলাম। সমাধির পাশেই একটা ছোট সংগ্রহশালা রয়েছে। সংগ্রহশালাটি বন্ধ ছিল। কর্তৃপক্ষকে বলার পর তারা আন্তরিকভাবে খুলে দিলেন। ভেতরে প্রবেশ করে আমরা দেখতে থাকলাম সবকিছু। চারপাশ কাঁচ দিয়ে ঘেরা থাকার কারণে সেখান থেকে চা বাগান দেখা যায় পরিপূর্ণরূপে, যা সংগ্রহশালাটির সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে।