একটু চালাক না হইলে নাকি এই যুগে আসিয়া টিকিয়া থাকা মুশকিল। বাঙালির চালাকি নাকি হাড়ে-মজ্জায়। যদিও কেহ কেহ বলিয়া থাকেন—এখন করিবে চালাকি, পরে বুঝিবে জ্বালা কী? আপাতদৃষ্টিতে অনেকেই মনে করেন, পশ্চিমা বিশ্বের মানুষ নাকি বোকা। কারণ, তাহারা উপরচালাকি করেন না। তাহাদের মন-মুখ সাধারণত আলাদা হয় না। তাহারা যখন যেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তখন তাহাকে অন্তর হইতে লালন করেন। অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ খুব ভালো করিয়া জানেন, কী করিয়া তাহার প্রতিষ্ঠানকে ভাঙাইয়া খাওয়া যায়। একটি প্রতিষ্ঠান হইল সোনার ডিম পাড়া হাঁস; কিন্তু এই হাঁসটির পেট হইতে তত্ক্ষণাত্ অধিক ডিম পাইতে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ পেট কাটিয়া ফেলিতেও দ্বিধা করেন না। হাঁস মারা গেলে তাহাদের কী? তাহারা তো হাঁসের মালিক নহেন। এই চিত্র সর্বত্র বিরাজিত। সরকারের উপরমহল হইতে রাস্তার ফুচকা বিক্রেতার বেতনভুক ছোট কর্মচারী পর্যন্ত এই মানসিকতায় নিজেকে বিশেষ ‘চালাক’ বলিয়া মনে করেন।
উদাহরণস্বরূপ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের কথাই বলা যায়। সরকার যখন একটি প্রকল্প গ্রহণ করে, তখন তাহার অনেক হিসাবনিকাশ থাকে। সরকারের ভাবমূর্তি, প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের বিষয় ছাড়াও উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে আগাইয়া লইবার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাত্ উদ্দেশ্য অত্যন্ত সত্ ও ইতিবাচক; কিন্তু যাহারা এই সকল প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, তাহাদের একেবারে উপরস্তর হইতে নিচের সারি অবধি অধিকাংশ কর্মচারীর ভাবনা থাকে ঐ উন্নয়ন হইতে কী করিয়া ‘টু-পাইস’ অতিরিক্ত উপার্জন করা যায়! এই ক্ষেত্রে তাহারা কেবল নিজেদের ব্যক্তিগত মুনাফাটাই চাহেন, দেশের উন্নয়ন লইয়া তাহাদের মাথাব্যথা নাই। তেমনিভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মীরা সাধারণত নিজেদের আখের গুছাইতেই ব্যস্ত থাকেন। প্রতিষ্ঠানের লাভক্ষতি লইয়া তাহাদের মাথাব্যথা থাকে না বলিলেই চলে। অনেকে বলিতে পারেন, প্রতিষ্ঠানও বহু ক্ষেত্রে তাহার কর্মীদের প্রতি ন্যায্যবিচার করেন না, যখন-তখন চাকুরিচ্যুত করিয়া থাকেন; কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, প্রতিষ্ঠানকে দেশের আইনের ভিতরে একটি নিয়মের মধ্যেই চলিতে হয়। এই জন্য প্রতিষ্ঠান যাহা করে নিয়মের মধ্যে করে। কোনো প্রতিষ্ঠানেরই সাধারণত যথেচ্ছাচার আচরণ করিবার সুযোগ নাই। প্রতিষ্ঠানকে আত্মগত না করিবার কারণে তৃতীয় বিশ্বে শতাব্দী এমনকি অর্ধশতাব্দীকাল ধরিয়া খুব অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠানই টিকিয়া থাকিতে পারে। অথচ উন্নত বিশ্বের মানুষ তাহাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি আত্মোত্সর্গ করিয়া থাকেন। প্রতিষ্ঠানকে তাহারা নিজের সত্তার অংশ বলিয়া মনে করেন। এই জন্য প্রতিষ্ঠানগুলিও তাহাদের শিকড় বিছাইতে পারে বহু দূর অবধি, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া তাহারা মাথা উঁচু করিয়া টিকিয়া থাকে।
একটু চালাক না হইলে নাকি এই যুগে আসিয়া টিকিয়া থাকা মুশকিল। বাঙালির চালাকি নাকি হাড়ে-মজ্জায়। যদিও কেহ কেহ বলিয়া থাকেন—এখন করিবে চালাকি, পরে বুঝিবে জ্বালা কী? আপাতদৃষ্টিতে অনেকেই মনে করেন, পশ্চিমা বিশ্বের মানুষ নাকি বোকা। কারণ, তাহারা উপরচালাকি করেন না। তাহাদের মন-মুখ সাধারণত আলাদা হয় না। তাহারা যখন যেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তখন তাহাকে অন্তর হইতে লালন করেন। অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ খুব ভালো করিয়া জানেন, কী করিয়া তাহার প্রতিষ্ঠানকে ভাঙাইয়া খাওয়া যায়। একটি প্রতিষ্ঠান হইল সোনার ডিম পাড়া হাঁস; কিন্তু এই হাঁসটির পেট হইতে তত্ক্ষণাত্ অধিক ডিম পাইতে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ পেট কাটিয়া ফেলিতেও দ্বিধা করেন না। হাঁস মারা গেলে তাহাদের কী? তাহারা তো হাঁসের মালিক নহেন। এই চিত্র সর্বত্র বিরাজিত। সরকারের উপরমহল হইতে রাস্তার ফুচকা বিক্রেতার বেতনভুক ছোট কর্মচারী পর্যন্ত এই মানসিকতায় নিজেকে বিশেষ ‘চালাক’ বলিয়া মনে করেন।
দৈনিক ইত্তেফাকের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন
উদাহরণস্বরূপ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের কথাই বলা যায়। সরকার যখন একটি প্রকল্প গ্রহণ করে, তখন তাহার অনেক হিসাবনিকাশ থাকে। সরকারের ভাবমূর্তি, প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের বিষয় ছাড়াও উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে আগাইয়া লইবার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাত্ উদ্দেশ্য অত্যন্ত সত্ ও ইতিবাচক; কিন্তু যাহারা এই সকল প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, তাহাদের একেবারে উপরস্তর হইতে নিচের সারি অবধি অধিকাংশ কর্মচারীর ভাবনা থাকে ঐ উন্নয়ন হইতে কী করিয়া ‘টু-পাইস’ অতিরিক্ত উপার্জন করা যায়! এই ক্ষেত্রে তাহারা কেবল নিজেদের ব্যক্তিগত মুনাফাটাই চাহেন, দেশের উন্নয়ন লইয়া তাহাদের মাথাব্যথা নাই। তেমনিভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মীরা সাধারণত নিজেদের আখের গুছাইতেই ব্যস্ত থাকেন। প্রতিষ্ঠানের লাভক্ষতি লইয়া তাহাদের মাথাব্যথা থাকে না বলিলেই চলে। অনেকে বলিতে পারেন, প্রতিষ্ঠানও বহু ক্ষেত্রে তাহার কর্মীদের প্রতি ন্যায্যবিচার করেন না, যখন-তখন চাকুরিচ্যুত করিয়া থাকেন; কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, প্রতিষ্ঠানকে দেশের আইনের ভিতরে একটি নিয়মের মধ্যেই চলিতে হয়। এই জন্য প্রতিষ্ঠান যাহা করে নিয়মের মধ্যে করে। কোনো প্রতিষ্ঠানেরই সাধারণত যথেচ্ছাচার আচরণ করিবার সুযোগ নাই। প্রতিষ্ঠানকে আত্মগত না করিবার কারণে তৃতীয় বিশ্বে শতাব্দী এমনকি অর্ধশতাব্দীকাল ধরিয়া খুব অল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠানই টিকিয়া থাকিতে পারে। অথচ উন্নত বিশ্বের মানুষ তাহাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি আত্মোত্সর্গ করিয়া থাকেন। প্রতিষ্ঠানকে তাহারা নিজের সত্তার অংশ বলিয়া মনে করেন। এই জন্য প্রতিষ্ঠানগুলিও তাহাদের শিকড় বিছাইতে পারে বহু দূর অবধি, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া তাহারা মাথা উঁচু করিয়া টিকিয়া থাকে।
প্রশ্ন হইল, নিজেদের ব্যক্তিগত আখের না গুছাইয়া প্রতিষ্ঠানের প্রতি নিবেদিত থাকিয়া উন্নত বিশ্বের মানুষ কি বোকামি করেন? তৃতীয় বিশ্বে যাহারা নিজের আখের গুছাইতে সদাব্যস্ত—তাহারাই তো চালাক। বলিবার অপেক্ষা রাখে না—অতি চালকের গলায় দড়ি। সেই যে একটি বিখ্যাত কার্টুন আছে, একটি নৌকার এক প্রান্তে বসিয়া আছে চালাক ও সুবিধাবাদী কিছু লোক, অন্যপ্রান্তে আছে কিছু সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের প্রান্তে নৌকাটির তলায় হঠাত্ একটি বড় ফুটা হইয়া যায়। সেই ছিদ্র ঠিক করিতে সাধারণ মানুষ যখন প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছে, তখন অন্য প্রান্তের সুবিধাবাদী নিজেদের লইয়া আত্মনিমগ্ন রহিয়াছে। ভাবিতেছে, নৌকার ঐ প্রান্তে ফুটা হইলে আমাদের কী—আমাদের প্রান্তে তো ছিদ্র হয় নাই।
প্রকৃতপক্ষে, দেশের উন্নয়নকে নষ্ট করিয়া, সোনার ডিম পাড়া হাঁসের পেট কাটিয়া, প্রতিষ্ঠানের প্রতি ন্যূনতম ভালোবাসা না রাখিয়া সুবিধাবাদী চালক মানুষ অল্প কিছুদিন ভালো থাকিতে পারেন মাত্র। উন্নত বিশ্ব কেন উন্নত হইয়াছে, তাহার উত্তর তাহাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার ভিতরেই লুকাইয়া রহিয়াছে। সুতরাং তৃতীয় বিশ্ব নাকি উন্নত বিশ্বের মানুষ প্রকৃত বুদ্ধিমান—তাহা আর বলিবার অপেক্ষা রাখে না। বুদ্ধিমান না হইলে কোনো জাতি টিকসই উন্নয়নের সোপান নির্মাণ করিতে পারে না।