নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সম্ভাব্য সংস্কার

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে আমি ইতোমধ্যে অনেক জায়গায় এটিকে একটি ‘স্মার্ট মন্ত্রিসভা’ হিসেবে উল্লেখ করেছি। এই মন্ত্রিসভার একজন মন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয়ের বিষয়াবলি নিয়ে এই প্রবন্ধটি। তিনি যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন, সেই মন্ত্রণালয়ের অধীনে আমি এক সময় কাজ করেছি। অধিকন্তু সেই মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত বিষয়াবলি নিয়ে আমি দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় কাজ করেছি। এ ছাড়া সরকারি কাজে যখন আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি তখন এই বিষয়গুলো আমার কাজের মধ্যে বিভিন্ন সময় এসেছে; বিশেষ করে আমি যখন জেনেভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে কর্মরত ছিলাম। সেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী বোর্ডে বাংলাদেশের বিকল্প সদস্য হিসেবে সেই মন্ত্রণালয়ের অনেক বিষয়বস্তু নিয়ে আমাকে কাজ করতে হয়েছিল। এই মন্ত্রণালয়টি হচ্ছে ‘স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।’

প্রধানমন্ত্রী এবারের মন্ত্রিসভা গঠনের সময় অনেকগুলো চমক নিয়ে এসেছেন। যার একটি হচ্ছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ডা. সামন্ত লাল সেনকে মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া। ’৭৫ থেকে ৯০-এর স্বৈরশাসনের সময়কাল ছাড়া কোনো এমপি ব্যতিরেকে কেউ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাননি। মাঝখানে অবশ্য ২০০৭ থেকে ২০০৮ সময়কালে সংসদের অনুপস্থিতিতে একটি অনির্বাচিত সরকার ছিল। সেই সময়টুকু বাদ দিলে বলা যায়, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ইতিহাসে সব সময়ই একজন সংসদ সদস্য এই মন্ত্রণালয়টির মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। সেই হিসেবে ডা. সামন্ত লাল সেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি পাওয়া আমাদের সবার কাছেই নিঃসন্দেহে একটি চমকপ্রদ বিষয়। তবে আমরা যদি ডাক্তার হিসেবে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় তার অপরিসীম অবদানের বিষয়টি বিবেচনায় আনি তা হলে তার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার বিষয়ে অবশ্যই কোনো সংশয় থাকার অবকাশ নেই। ডা. সামন্ত লাল সেনের একক নেতৃত্বে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

২০১৩-২০১৪ সময়কালে ও তার পর যারা বাংলাদেশে অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন তাদের চিকিৎসায় এই ইনস্টিটিউট ও তার অবদানের কথা আমাদের সবার জানা। আমি বলব যে, একজন চিকিৎসক হিসেবে এবং এই হাসপাতালের একজন ব্যবস্থাপক হিসেবে তিনি সফল নেতৃত্ব প্রদর্শন করেছেন। তার ব্যক্তিগত সততা এবং কর্মদক্ষতার কারণে তিনি প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক আজকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। সর্বোপরি মন্ত্রী কে হবেন তা সংবিধান মোতাবেক পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। তিনি যাকে যোগ্য মনে করবেন তাকেই মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। আমরা ডা. সামন্ত লাল সেন মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় আন্তরিক অভিনন্দন জানাই ও তার সর্বাত্মক সাফল্য কামনা করি।

মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই তার বেশ কিছু প্রাথমিক বিবৃতি ইতোমধ্যে আমরা সবাই শুনেছি। ডাক্তার হিসেবে আমি বলব, এগুলো অনেক সাহসী উচ্চারণ। অনেক প্রতিষ্ঠিত ও ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদরাও এটি বলতে সাহস করেন না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার ‘জিরো টলারেন্স’-এর ঘোষণা সবাইকে আশা জুগিয়েছে, যেহেতু স্বাস্থ্য খাতের তথাকথিত দুর্নীতি দেশে বহু আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনি যে সমস্যাগুলো ইতোমধ্যে চিহ্নিত করেছেন, সেগুলো অতিপরিচিত ও স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বড় অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত। এগুলোর সমাধান করতে না পারলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা জানি তার অধীনে দুজন সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুই মহাপরিচালকসহ অসংখ্য কর্মকর্তা ও চিকিৎসক সারাদেশে কাজ করছেন। আমি বিশ্বাস করি, মন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে এই সমস্যাগুলো দূর করতে মন্ত্রীকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করবেন এহং বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে এবং আমাদের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করতে অবদান রাখবেন। পাশাপাশি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) আওতায় ২০৩০ সালে স্বাস্থ্য খাতে আমাদের যেসব লক্ষ্য রয়েছে সেগুলো অর্জনেও অবদান রাখবেন। আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে চাই আমাদের মাঠ পর্যায়ে বিশেষত গ্রাম ও উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রয়োজনীয পরিবর্তন না আনতে পারলে এবং মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে না পারলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি ও যথোপযুক্ত সেবা প্রদানের বিষয়ে প্রশ্ন রয়ে যাবে। মন্ত্রী তার প্রাথমিক বিবৃতিতে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং তা সমাধানের কথা বলেছেন।

আমরা যদি আমাদের চিকিৎসকদের গ্রামাঞ্চলে কাজের ও থাকার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে না পারি তা হলে তারা সেখানে কাজ করতে উৎসাহিত হবেন না। এর জন্য বিশেষ প্রণোদনা ব্যবস্থার বিষয়টিও বিবেচনায় আনা দরকার। এই বিষয়টি উনি আশা করি ভালোভাবেই জানেন এবং তা বাস্তবায়নে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত চিকিৎসকদের সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানো অতিজরুরি। দ্বিতীয়ত, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ও মেডিক্যাল শিক্ষার মান নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়েছে। আমাদের দেশে এখন সিঙ্গাপুর ও ভারতের মতো অনেক বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। তবে আমাদের দেশের ধনী শ্রেণি যাদের এসব হাসপাতালে সেবা নেওয়ার সামর্থ্য আছে তারা সহজে এসব হাসপাতালে যেতে চান না। তারা সম্ভব হলে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করান। এর একটি প্রধান কারণ হলো, তাদের এবং আমাদের অনেকের মতেই আমাদের এসব হাসপাতালে সেবার মান ভালো নয়। সর্বোপরি তাদের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণ হলো এসব হাসপাতাল স্বাস্থ্যসেবার বদলে ব্যবসাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বিভিন্নভাবে এবং দীর্ঘ সময়ব্যাপী এই সত্যটি বেরিয়ে এসেছে যে, এসব বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে সেবার চেয়ে ব্যবসায়িক দিকগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে। আমাদের ডায়াগনস্টিকসের মান নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের অনিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট প্রাকটিস আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে আরেকটি বড় বাধা।

আরেকটি বিষয় হলো, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ নিয়ে। এটি নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। আমি প্রথমেই বলব যে স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের কোনো বিকল্প নেই। এসব খাতে বিনিয়োগ কম হওয়ার অর্থ সরকারের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যাহত হওয়া এবং একটি দেশের ও জাতির দ্রুত ও টেকসই উন্নয়ন ব্যাহত করা।

গবেষণার কথা আগে আরেকবার বলেছি। আবারও বলছি, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার মান অত্যন্ত নিম্নমানের এবং গবেষণার সুযোগও খুবই কম। এ খাতে সরকারি বরাদ্দও অনেক কম। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে গবেষণার বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ নেই এবং এ সংক্রান্ত কোনো নীতিমালাও তেমন নেই বা থাকলেও তার সঠিক কোনো বাস্তবায়ন নেই। এই বিষয়গুলোর সমাধান করা জরুরি। আশা করি নবনিযুক্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অধীনে এই বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে দেখা হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কমিউনিটি ক্লিনিক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশে বর্তমানে আমার জানামতে, চৌদ্দ থেকে আঠারো হাজারের মতো কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রশংসা করা হয় এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে এর আদলে কীভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন করা যায় সে সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা (ৎবংড়ষঁঃরড়হ) পাস হয়েছে। আমার মতে, কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু তথা ‘নিউক্লিউয়াস’ হিসেবে কাজ করতে পারে। সেভাবে এটিকে তৈরির জন্য অনেক কাজ করা দরকার, যেটি করা হয়নি বা করা হচ্ছে না। সেগুলোকে চিহ্নিত করে বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপক কর্মযজ্ঞ দরকার, যা আমাদের নবনিযুক্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে হাতে নিতে পারেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এটি আমাদের সবার প্রত্যাশা। গত সপ্তাহে আমাকে কানাডার বিশ্বখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় ‘বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর : স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন’ নামক ইংরেজিতে রচিত বইটির স্মারক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ হয়ে সেখানে আমি আমার বক্তৃতায় কমিউনিটি ক্লিনিকের বিষয়ে বিস্তর আলোচনা করেছি এবং সেখানে আমি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কথা বলেছি। সেখানে আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো থেকে শুরু করে জনশক্তির উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ, উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপকদের দায়বদ্ধতাসহ সংশ্লিষ্ট আরও অনেক বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের ওপর আলোকপাত করেছি।

পরিশেষে আমি বলেছি, কীভাবে কমিউনিটি ক্লিনিক সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি নিশ্চিত করতে সরকার কীভাবে বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এবং ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্বখ্যাত শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করতে পারে তা ব্যাখ্যা করেছি। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার মাধ্যমে এবং এর মূল লক্ষ্যকে সম্প্রসারিত করে বাংলাদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব। এটা করার জন্য অনেকগুলো বিষয় বা উপাদান রয়েছে যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়। এই উপাদানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে আমরা কমিউনিটি ক্লিনিককে কীভাবে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিণত করতে পারি সেটি নবনিযুক্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী খতিয়ে দেখবেন এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে আমি প্রস্তাব করছি।

ড. খলিলুর রহমান : কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • বৃহস্পতিবার (রাত ৮:১২)
  • ৯ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১লা জিলকদ, ১৪৪৫ হিজরি
  • ২৬শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com