সংস্কৃতি অঙ্গনে বছরের প্রথম শোক। উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতে নক্ষত্রপতন। না ফেরার দেশে চলে গেছেন বরেণ্য শিল্পী ওস্তাদ রশিদ খান। গতকাল বিকেল পৌনে ৪টার দিকে কলকাতার একটি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর। কয়েক বছর ধরে প্রস্টেট ক্যানসারে ভুগছিলেন রশিদ খান।
সম্প্রতি তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক) হয়। এরপর তড়িঘড়ি হাসপালে ভর্তি করানো হয় তাকে। ভেন্টিলেশন তথা লাইফ সাপোর্টেও রাখা হয়েছিল এই শিল্পীকে। কিন্তু ফেরানো যায়নি আর। তিনি ছিলেন সংগীতের এক গ্লোবাল সুপারস্টার। তার স্মরণে দেশি-বিদেশি শিল্পীরা শোক প্রকাশ করছেন। সেই সকল তাত্ক্ষণিক শোক নিয়েই শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য—
তপন চৌধুরী
ওস্তাদ রশিদ খান, শাস্ত্রীয় সংগীতের এক অনবদ্য শিল্পী। তার সাথে সাক্ষাত্ হয়েছিল। আমি আর সুবীরদা ছিলাম সেই অনুষ্ঠানে। এত স্বভাব বিনয়ী মানুষ আমি কম দেখেছি। আর তার কণ্ঠশৈলী নিয়ে তো কিছু বলার নেই। এত সুললিত কণ্ঠ এই পৃথিবীতে খুব কম। বড় অল্প সময় থাকলেন তিনি এ পৃথিবীতে। তাকে আমাদের এই সংগীতবিশ্বে আরো অনেক কাল প্রয়োজন ছিল।
মেসবাহ আহমেদ
তার অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর থেকেই আমি এমন কোনোদিন নেই যে তার জন্য প্রার্থনা করিনি। তার সাথে আমার সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছিল। আমি আশীর্বাদ নিতে গিয়ে বলেছিলাম, আল্লাহ যেন আমার আয়ু থেকে হলেও আপনাকে দীর্ঘ জীবন দেন। আপনি যে আমাদের জন্য কত বড় অনুপ্রেরণা তা বলে বোঝাতে পারবো না। তিনি চলে গেলেন । পৃথিবীকে তিনি তার সুরের ইন্দ্রজালে আসক্ত করে রাখতেন। এক অদ্ভুত মাদকতা। তার বন্দিশ যারা সরাসরি শুনেননি তারা জীবনে অনেক কিছু মিস করে ফেলেছেন।
সামিনা চৌধুরী
ওস্তাদ রশিদ খান আমার প্রতিদিনের সঙ্গী। এমন একজন শিল্পী নেই, এত অসময়ে! তার অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর থেকেই মনটা খারাপ ছিল। এই শূন্যতা ব্যাথাতুর, বলে বোঝাতে পারবো না। আমাদের শাস্ত্রীয় সংগীত উত্সবে তার পরিবেশনা বুঁদ হয়ে শুনতাম। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
অজয় চক্রবর্তী
আমি এখন কোনোরকম কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই। শব্দ হারিয়ে ফেলছি। ও তো আমার হাতেই তৈরি। চলে যাওয়ার বয়স তো এটা নয়। আজকে দেশের সংগীতজগত্ এক গুণী শিল্পীকে হারাল। রশিদ খান আমার মনে কতটা জায়গা নিয়ে রয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা আমি ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবো না। প্রথমে অসুস্থতার খবর। তারপর শুনলাম ভালো আছে। পরের দিনই এ রকম একটা দুঃসংবাদ! আমি এটা আশা করিনি।
কুমার সানু
ওস্তাদ রশিদ খানের সঙ্গে আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। মাঝে মাঝেই ওনার বাড়িতে যেতাম। আড্ডা খাওয়া-দাওয়া হতো। বিভিন্ন জায়গায় আমাদের দেখা হতো। দেখা হওয়ার পর আমাদের যে উচ্ছ্বাস এবং অনুভূতি হতো সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। কত শত স্মৃতি জমা হয়েছে আমাদের জীবনে! খবরটি শোনার পর থেকে আমি তো ভাবতেই পারছি না যে তিনি আর নেই। উনি আমাদের অনেককিছু দিয়ে গেলেন। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া উচিত হলো না! বন্ধুর আত্মার শান্তি কামনা করছি। ওনার পরিবারকে সৃষ্টিকর্তা শোক সইবার শক্তি দিন।
রাঘব চট্টোপাধ্যায়
রশিদ খান আমার দাদার মতো ছিলেন। ওনার কাছে কিছুদিন গান শেখার সুযোগও আমার হয়েছিল। তবে আমার চেয়ে বয়সে খুব বেশি বড় না হওয়ায় আমাদের ভেতর বন্ধুৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। দীর্ঘ ৩০ বছরের সম্পর্কে গানের পাশাপাশি আড্ডা, এমনকি একসঙ্গে খেলাধুলাও করতাম। উনি মস্ত বড় সংগীতজ্ঞ শুধু না, বিরাট মনের মানুষ ছিলেন।
শুভমিতা
ছোটবেলায় রশিদ খানের কাছে গান শিখতাম। নিয়মিত ওনার বাড়িতে যাতায়াত না থাকলেও গানের মাধ্যমে খুব ভালো একটা যোগাযোগ ছিল। তার অনুষ্ঠান হলেও চলে যেতাম এবং দেখা হলেও উনি বলতে একবার বাড়িতে আয়। কতটা খোলা মনের মানুষ ছিলেন সেটা ওনার সঙ্গে যারা মিশেছেন তারা জানেন। সংগীতের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল।
লোপামুদ্রা
যখন রশিদ খান হননি তখন থেকেই ওনাকে চিনি। এত তাড়াতাড়ি নক্ষত্রের পতন হবে ভাবতে পারছি না। পুরো ভারতবর্ষের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তবে সৃষ্টিকর্তার ওপর তো কারও হাত নেই। ওনার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
বাবুল সুপ্রিয়
বড় শিল্পীরা সত্যিই খুবই ক্ষণজন্মা হয়। কষ্টের বিষয় হলো ওনার অসুস্থতার সময় পাশে থাকা বা দেখতে পেলাম না। ক’দিন আগেও আমরা ওনার বাড়িতে গিয়ে গান-বাজনা করেছি। সবাই মানে আমি, জয় সরকার আরো কয়েকজন। খুব মজা করেছিলাম সারা সন্ধ্যা ধরে। তারপরও গিয়েছিলাম রেওয়াজ করতে। নিজের হাতে খাবার তৈরি করতে ভালোবাসতেন। এ রকম একজন শিল্পী, মানে কী বলবো! খুবই আড্ডাবাজ আর খুব ভালো একজন মানুষ ছিলেন। কঠিন পরিশ্রমে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। ওনার চলে যাওয়া সংগীতজগতের বিরাট বড় ক্ষতি। ওপারে ভালো থাকুক রশিদ খান, এই প্রার্থনা করছি।