উপনিবেশ শাসনের নানান নেতিবাচক দিকের মান্যতা সত্ত্বেও ভারতীয় সমাজে ইংরেজ শাসনের পরিকাঠামোতেই যোজনা হয়েছিল পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের ফসল। রেনেসাঁসের আলোকরশ্মির অনুগমন হয়েছিল ভারতীয় সমাজে। ভারতীয়দের গৃহীমন ও সাংস্কৃতিক সত্তায় দোলা দিল ইউরোপীয় সংস্কৃতির রেশমি পরশ। ভারতীয় সমাজ কাঠামোতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকল। সাহেবদের সঙ্গে যুক্ত হলো স্থানীয় এলিট। মানুষ অতীতের জরা, কূপমণ্ডূকতা পরিহার করে ইহজাগতিকতার পথে কিছুটা হাঁটতে শুরু করল। সমাজে প্রগাঢ় হলো জ্ঞানভিত্তিক জীবন-জিজ্ঞাসা। এই পথেই ১৭৮৪ সালের ১৫ জানুয়ারি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি স্যার উইলিয়াম জোনস ৩০ জন সমমনা ইউরোপীয় নাগরিক নিয়ে গঠন করেন ‘দি এশিয়াটিক সেসাইটি’। উদ্দেশ্য ছিল প্রাচ্যবিদ্যা অধ্যয়নের একটি নিয়মিত সংস্থা গড়ে তোলা। প্রতিষ্ঠাকালে জোর ছিল পদ্ধতিগত গবেষণার ওপর। সমসাময়িক সময়ে রাজা রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবা হেনরি ডিরোজিওর সংগঠন ও ব্যক্তিপর্যায়ের কর্ম ভারতীয় সমাজে রেনেসাঁসের দ্রুতি ছড়িয়েছে।
১৯৪৭-এর দেশভাগের পর বিচিত্র রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম হলে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা জনবান্ধব না হলেও ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদ, দেশাত্মবোধ, স্বাধিকারের আন্দোলন প্রবল হয়। স্বরাজ থেকে স্বাধিকর আন্দোলন জোরদারে পূর্ববঙ্গের সমাজ ও সংস্কৃতিতে নবজাগৃতি লাভ করে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণেই ১৯৫২ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভারততাত্ত্বিক ও পুরাতত্ত্ববিদ আহমদ দানী ছিলেন পূর্ববঙ্গে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মূল কুশীলব। বাংলাদেশের জন্মলগ্নেই ১৯৭২ সালে সংগত কারণেই সোসাটির নাম পরিবর্তন হয়ে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ হয়। এই অঞ্চলের মানুষ ও প্রকৃতি নিয়ে কাজ করার প্রত্যয় ছিল যাত্রাকালে। স্বাধীন দেশে ১৮৬০ সালের সোসাইটি অ্যাক্টের অধীনে নিবন্ধিত হয়ে চললেও লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দার্শনিক মূল ভিত্তি কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত (১৭৮৪) এশিয়াটিক সোসাইটির উত্তরসূরি। উপনিবেশপর্বে সূচনাকালে সোসাইটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক গভর্নর জেনারেল ছিলেন বাংলাদেশ পর্বে রাষ্ট্রপতি পদাধিকারবলে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
অলাভজনক ও অরাজনৈতিক চরিত্র ঘোষণায় প্রতিষ্ঠানটিকে সর্বজনীন করার প্রয়াস আছে। জ্ঞান অন্বেষী, গবেষণা নিবিড় প্রতিষ্ঠান বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানটির প্রতি সারাদেশের কাঠামোবদ্ধ গবেষক অনুসন্ধিৎসু মানুষের আগ্রহ আছে। এশিয়াটিক সোসাইটির ১৭ সদস্যের ২ বছর মেয়াদের কার্যনির্বাহী পরিষদ রুলস অব বিজনেজের মান্যতায় বিধিবদ্ধ বেশকিছু কাজ করে। যেমন মাসিক সভা, মাসিক সেমিনার, ট্রাস্টফ্রান্ড বক্তৃতা, জার্নাল, বুলেটিন প্রকাশ, বই প্রকাশনা, গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতা, প্রতিষ্ঠাবাষিকী উদযাপন ইত্যাদি। আকারে ছোট ও নিদর্শন স্বল্প হলেও ঢাকা নিয়ে আগ্রহী মানুষের জন্য এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর বেশ লোকপ্রিয়। এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগার মাঝারি আকারের। গ্রন্থাগারটি প্রধানত গবেষকদের জন্য উপযোগী। একটা বিষয় অনেকের কাছে অজানা সোসাইটির গ্রন্থাগারে পুঁথি, তাম্রসনদ, মুদ্রা, প্রতিকৃতি ও আবক্ষমূর্তির সংগ্রহ রয়েছে। যদিও সবকিছু পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত নয়।
সোসাইটি পরিচালিত বাংলাপিডিয়া প্রকল্প, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সমীক্ষা, ঢাকা প্রকল্পে তৃণমূল থেকে নগরের গবেষকদের কর্মযোগ ছিল। এসব প্রকল্প থেকে প্রকাশিত পুস্তকের প্রতিও আগ্রহ ছিল অনেকের। এ ছাড়া ছোটদের পিডিয়া, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফ্লোরা অ্যান্ড ফাইনা অব বাংলাদেশ, উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ, বাংলাদেশের ইতিহাস গ্রন্থমালা পাঠকমহলে পরিচিত। এশিয়াটিক সোসাইটির মতো প্রতিষ্ঠানের কাছে অংশীজনদের প্রার্থিত বিষয়ে একটু ভিন্নতা থাকে। সমাজের কলকব্জার নেতিবাচক দশার কথা কোনো দোহাই না টেনেই বলা যায় জ্ঞানের র্চ্চায় উন্মুখ অল্প কিছু মানুষজন অনিশ্চয়তায় ভোগে। তারা একটি জুতসই প্রতিষ্ঠান চায়। যদিও বর্তমান বাস্তববাদী সমাজে জ্ঞানের কতটুকু কদর তা অনুমেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে অনেক প্রতিষ্ঠানের নতজানু দশা হলেও এশিয়াটিক সোসাইটির মতো প্রতিষ্ঠান শক্ত ভিতে উদ্দেশ্য অভিমুখী হবে এমন প্রার্থনা। মানুষের দাঁড়ানোর ও ভরসার জায়গা ক্রমেই সংকুচিত। তাই মনোজমিনের বড় ক্যানভাসের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত হোক এমনটাই চাই। কর্মযোগ হোক প্রশস্ত ও ভেদহীন এমন স্বাপ্নিক দাবি অংশীজনদের। কাক্সিক্ষত না হলেও গত কয়েক বছরে এশিয়াটিক সোসাইটি পরিচালনায় স্থবিরতা দৃশ্যমান। নৈমিত্তিক কাজ ও বিধিবদ্ধ রুটিনের গণ্ডিতে সোসাইটি আটকে আছে। সর্বোপরি পরিচালনায় কর্তৃত্বরবাদী মনোভাব স্পষ্ট। ২০১৩ সালের মক্তিযুদ্ধের জ্ঞানকোষের (১০ খণ্ডের) পর বড় কোনো প্রকল্প নেই সোসাইটির। অনেক বিলম্বে প্রকল্প সমাপ্ত হলেও প্রকাশনাটি মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের কাছে আশানুরূপ গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের মানসম্মত গবেষণার সাইটেশনে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষের কম সাক্ষাৎ মেলে। বরং পাঠকমহলে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ব্যক্তি উদ্যোগের ১২ খণ্ডের ‘মুক্তিযুদ্ধ কোষ’ প্রকাশনাটি অধিক পাঠক সমাদৃত।
গত এক দশকে সোসাইটি জাতীয় ও সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে প্রণিধানযোগ্য কোনো গবেষণা নেই। সোসাইটির কার্যনির্বাহী কাউন্সিলের গবেষণা প্রকল্পের জন্য নতুন সরকারি, বেসরকারি তহবিলের সংস্থানের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। সরকারের অগ্রাধিকারের বিষয়ের পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) এশিয়াটিক সোসাইটি কোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে পারেনি। বরং কাউন্সিল নির্বাচনের দুপক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অপর পক্ষকে কর্মসহযোগী হিসেবে গ্রহণ না করে প্রতিপক্ষ হিসেবে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে কর্তৃত্ববাদী চরিত্র দান করেছে। সোসাইটির ফেলো থেকে সদস্য প্রদানে মুখচেনাচেনির বিষয়টির গুরুত্ব বেড়েছে। কিন্তু জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের সন্ধান ও তা প্রকাশের মাধ্যমে সমাজ জাগানিয়ায় এশিয়াটিক সোসাইটির কাছে এ দেশের বিদ্বান সমাজের অনেক চাওয়া। মৌলিক গবেষণা, গুণগত লেখা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, প্রশিক্ষণ, কনফারেন্স, প্রকাশনা প্রভৃতি কার্যক্রমের মাধ্যমে জাতীয় জনস্বার্থ রক্ষা ও গবেষণাবান্ধব পরিবেশ সৃজন করে সোসাইটি জাতীয় অভিলক্ষ্যে এগিয়ে যাবে স্মার্ট বাংলাদেশের এমনি চাওয়া।
এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে গবেষকদের সর্বজনীন ইনক্লুসিভ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার দায়বদ্ধতা আছে। এশিয়াটিক সোসাইটি জ্ঞান অন্বেষণের বাতিঘর হয়ে উঠবে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে, সবার এমন স্বগতোক্তি সঠিক দিশা দিতে পারে।