২০২৪ : সংকট ও চ্যালেঞ্জের বছরে সম্ভাবনার সন্ধান

নতুন বছরকে স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে দেশবাসীসহ বিশ্ববাসীকে জানাই নববর্ষের শুভকামনা। যদিও নতুন বছরের প্রথম দিন কোনো বিচ্ছিন্ন সূচনা আনতে পারে না, কেননা তা বিগত বছরেরই ধারাবাহিকতা। ধারাবাহিকতার মধ্যেই কালের নানা পরিমাপ করা হয়েছে মানবজীবনের ও মানবেতিহাসের বয়ান ধরে রাখার জন্য। সে হিসেবেই গতকাল ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ সাল শেষ হলো এবং আজ শুরু হচ্ছে ২০২৪ সাল।

এই নতুন বছরটা শুরু হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রচারণার মধ্যে। বছরের সাত দিনের মাথায়ই জাতীয় নির্বাচন। যদিও এবারও নির্বাচন প্রকৃত অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হতে পারছে না, তবুও যেন দেশে নির্বাচনী উন্মাদনা তৈরি হয়েছে। বলা যায়, দুই বড় দলের মধ্যে আওয়ামী লীগের কৌশল অধিকতর কাজ দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে এবারে বোধহয় ভুলই করল। তবুও বলতে হবে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হাতে রাখতে সক্ষম হলেও রাজনৈতিক টানাপড়েন, গণতন্ত্রের সংকট ও এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা আগামীতেও কাটবে বলে মনে হয় না। আবার এ সত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার অবস্থান ও ভাবমূর্তি শক্তিশালীই হবে বলে মনে হচ্ছে। এর কারণ দুটি- দেশে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী এখন আর নেই, আবার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইউক্রেন-রুশ যুদ্ধ ও গাজা সংকট নিয়ে তার দৃঢ় অবস্থান ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের স্পষ্ট সমালোচনা তাকে বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে বিশিষ্ট স্থান দেবে।

২.

কোভিড অতিমারীর পর বিশ্ব অর্থনীতি যখন উত্তরণের কাজে নিয়োজিত তখন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলমান রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান চাপ এবং এ বছরের শেষ পর্যায়ে এসে ইসরায়েলে হামাসের হামলা ও তার প্রতিক্রিয়ায় গাজায় তাদের ভয়ঙ্কর আক্রমণ বিশ্ব অর্থনীতির বিপর্যয় বাড়িয়েছে। সারা বিশ্বের মতোই বাংলাদেশও অর্থনৈতিক মন্দায় ভুগছে। কিছুতেই ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। তাতে যুক্ত হয়েছে ঋণখেলাপি ও অর্থপাচারের মতো দুর্নীতি থামানোর কার্যকর উদ্যোগের অভাব। সব মিলিয়ে উন্নয়নের গতিতে থাকা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০২৩ সালে হোঁচট খেয়েছে।

এর বিপরীতে সরকার বড় কয়েকটি প্রকল্প চালু করে দিয়েছে। বোঝা যায়, ক্রমবর্ধমান আর্থিক সংকট ও চাপে থাকা জনগণের মধ্যে একটু স্বস্তি ফেরানোই মূল লক্ষ্য। আগেই চালু হওয়া পদ্মা সেতুতে এবার রেল সেতু যুক্ত হওয়ায় দক্ষিণের মানুষ এই প্রকল্পের সার্বিক সুবিধা পেতে শুরু করেছে। রাজধানী ও তার আশপাশের এলাকার মানুষ বিভিন্ন উড়ালসেতু ও সড়ক উন্নয়নের সুফল পেয়ে সরকারকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করেছেন বলে মনে হয়। বিভিন্ন জেলায় ও জেলা শহরেও বেশ কিছু উন্নয়নের কাজ হয়েছে। তা ছাড়া দারিদ্র্যবান্ধব কার্যক্রমের প্রসার ঘটেছে বলে তার প্রভাবও সমাজজীবনে প্রতিফলিত হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে নানা সমস্যা হলেও তাদের ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা অব্যাহত রয়েছে। গত বছর থেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুও ছিল সরকারের একটি ব্যতিক্রমী ভালো প্রকল্প। হয়তো বঙ্গবন্ধু টানেল, শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের উদ্বোধনের আশু সুফল তেমন মিলবে না, তবে অদূর ভবিষ্যতে দেশ যে উপকৃত হবে তাতে সন্দেহ নেই। ঢাকার নাগরিকরা যে মেট্রোরেলের উপকার পেতে শুরু করেছেন, তা গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে।

৩.

তবে ঘুরেফিরে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ে অভিযোগ-সমালোচনা সারা বছরই চলেছে। একইভাবে শেষ পর্যন্ত থামেনি ডেঙ্গুজ্বরের আক্রমণ। সারা বছরে প্রায় সোয়া তিন লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন ডেঙ্গুতে আর মারা গেছেন ১৭শ জন। সারা বছর ডিম, পেঁয়াজ, আলু, চিনি, ডালের দাম বেশিই ছিল। সবজি ও গরুর মাংসের দাম ওঠানামা করলেও সাধারণের জন্য তা বাড়তি মূল্যেই থেকেছে। বিভিন্ন হিসাবে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের বাঁধা আয়ের মানুষের আর্থিক ভোগান্তি পিছু ছাড়েনি। এর মধ্যে সরকারের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে থাকল রিজার্ভের ব্যাপক অবনমন। ২০২১-এ যখন করোনার কারণে আমদানি প্রায় বন্ধ ছিল তখন রিজার্ভ উঠেছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারে। আর বর্তমানে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ১৯.৪০ বিলিয়ন ডলারে। যে কোনো দেশের অর্থনীতির স্থিতির জন্য অন্তত ৩ মাসের আমদানি ব্যয় ও ঋণ পরিশোধের সংস্থান থাকতে হয়। এ দুই খাতে বাংলাদেশের প্রয়োজন মাসিক ৬ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে আমরা রিজার্ভ নিয়ে যে শঙ্কায় আছি তা বলাই বাহুল্য। সরকার মুখে তেমনভাবে স্বীকার না করলেও মার্কিন ভিসানীতিও যে একটা চাপ তৈরি করছে তাতেও সন্দেহ নেই। সরকারের আরও দুই দুশ্চিন্তার বিষয় হলো অব্যাহত টাকা পাচার এবং রেমিট্যান্সের ক্রম সংকোচন।

উন্নয়নের বিপরীতে ভাবতে হবে সরকারের ঋণের কথা- আইএমএফ ছাড়াও চীন, জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে এ সরকার অনেক ঋণ নিয়েছে। উন্নয়নের জন্য এবং সংকট মোকাবিলায় যে কোনো সরকারই ঋণ নিয়ে থাকে। তবে তা যেন নিজেদের জন্য ভবিষ্যৎ সংকট তৈরি না করে সেদিকটা খেয়াল রাখা জরুরি। সাম্প্রতিককালে শ্রীলংকার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথা আমরা জানি। আগামী বছর থেকে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের হার অনেক বাড়বে। প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ না হলে এ নিয়ে সংকট তৈরি হতে পারে। তবে আমাদের সরকারপ্রধান গোড়া থেকে সংকট সামলেই সামনে এগোচ্ছেন। বিডিআর বিদ্রোহ থেকে প্রাকৃতিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানাবিধ সংকট তিনি ও তার সরকার মোকাবিলা করেই সামনে এগিয়েছেন।

৪.

আগেই আমরা বলেছি, বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মধ্য দিয়েই চলেছে। অর্থনীতির এই চাপ এ বছর আরও বাড়বে বলেই আমাদের মনে হয়। ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গাজা এবং ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সমস্যা। মনে হচ্ছে প্রথমটির মতো দ্বিতীয়টিও দীর্ঘায়িত হবে। এমনকি পরেরটির সূত্রে আঞ্চলিক যুদ্ধ বাধার ঝুঁকিও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এর মধ্যেই এ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হবেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী, রিপাবলিকান প্রার্থী কে হবেন তা এখনো অনিশ্চিত। তবে বাইডেন যে দুর্বল প্রার্থী তা দেশটির খোদ ডেমোক্র্যাট পর্যবেক্ষকরাও মানছেন। আবার রিপাবলিকানরা সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রার্থিতা নিয়ে আশাবাদী থাকলেও এখন নানা আইনি জটিলতায় এ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। তবে তাদের গণতন্ত্রের কাঠামো অত্যন্ত মজবুত, দুর্বল প্রেসিডেন্ট নিয়েও তাদের পক্ষে দেশের ও বাইরের সংকট সামলানো সম্ভব। এদিকে ব্রাজিলে বামপন্থি ধারার লুলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বৈশ্বিক অঙ্গনে জলবায়ু পরিবর্তনসহ বেশ কিছু ইস্যুতে গণমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে। বিশ্বের প্রধান অক্সিজেন ভা-ার আমাজন বনের বড় অংশের অধিকারী দেশ হিসেবে তার নেতৃত্বে ব্রাজিলও অপেক্ষাকৃত ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে থাকবে। বছরের শেষ আন্তর্জাতিক ইস্যু ছিল দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮। অনেক দেনদরবার ও টালবাহানার পর জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার ও দূষিত বায়ু নিঃসরণ হ্রাসে করণীয় নিয়ে এখানে সঠিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

৫.

সামগ্রিকভাবে বিচার করলে গত বছর পৃথিবীতে সংকট বেড়েছে। আগামী বছর তা কাটতে শুরু করবে কিনা তা বলার সময় এখনো আসেনি। ফলে বছরটিতে আশা যেমন থাকবে, তেমনি আশঙ্কাও কম থামবে না। বাংলাদেশে উন্নতির গতি ধরে রাখার চেষ্টা থাকবে সরকারের, বাজারের অস্থিরতাও থাকবে বলেই মনে হয়, অর্থনীতিও পুরোপুরি চাপমুক্ত হবে না। তবে এর মধ্যেই ক্রীড়া, চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদি এবং পেশাজীবনে, নারীর ক্ষমতায়নে নানা পারদর্শিতার যেসব স্বীকৃতি ও প্রমাণ মিলেছে তাতে গত বছরে যেমন প্রাপ্তি ছিল বেশ আগামীতেও তার ধারাবাহিকতা থাকবে বলে মনে হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সরকার যে নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করেছে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে দেশে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। জরুরি এ বিষয়টি সরকার ও জনগণ অনুধাবন করবে বলেই আমাদের মনে হয়।

সবশেষে বলব, আগামী দিনে দেশের এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সংকটময় দিনগুলো নেতৃত্বের ভালো পরীক্ষা নেবে। বলা যায়, সেটা রাষ্ট্রনেতাদের জন্য যেমন একটা পরীক্ষা, তেমনি সুযোগও বটে। সেদিক থেকে বলা যায়, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর জন্যও আগামী বছর একটি সুযোগ হয়েই আসবে। একইভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের জন্য নানা ক্ষেত্রে সংকট ও চ্যালেঞ্জ থাকলেও সুযোগ ও সম্ভাবনাও থাকবে। ফলে নেতৃত্বের চাই দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা এবং প্রয়োজনে ঔদার্য, মহত্ত্ব এবং বৃহত্তর স্বার্থে সমঝোতা, সহিষ্ণুতার মনোভাব।

 

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • বুধবার (সন্ধ্যা ৬:৪৯)
  • ১লা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ২২শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • ১৮ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com