দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনপরবর্তী রাজনীতি

বিএনপি, জামায়াত, বামজোটসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের বর্জন এবং নির্বাচন প্রতিহত করার নামে ট্রেনে আগুন লাগিয়ে মানুষ হত্যা, ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেওয়া এবং টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতালের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল। যা বলা হয়েছিল সেটাই ঘটেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে নির্বাচন বললে দুটি বিষয়ই বেশি আলোচিত হয়। একটি হলো উৎসব, অন্যটি সহিংসতা। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সহিংসতা সে মাত্রায় ছিল না, তবে নির্বাচন বর্জনকেন্দ্রিক সহিংসতা ছিল। সেটা অবশ্য নির্বাচনের দিন পরিবেশকে সেভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। উৎসব কতটা হয়েছে সে নিয়ে মিশ্র বক্তব্য আছে। বিএনপি নির্বাচনে না আসায় যারা বলছে অংশগ্রহণমূলক হয়নি তারা মনে করে এই নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়নি। ক্ষমতাসীন দল বলছে, সহিংসতা, আগুন সন্ত্রাস করেও মানুষকে নির্বাচন থেকে বড় আকারে দূরে রাখা যায়নি, তাই এই নির্বাচন উৎসবের সঙ্গেই হয়েছে।

আমরা আগে থেকেই বলে আসছিলাম যে, এই নির্বাচনটি শেখ হাসিনার কাছে কেবল আরেকটি নির্বাচন নয়। শাসনব্যবস্থা ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে, নির্বাচনকে দৃশ্যমান সুষ্ঠু করতে নির্বাচনের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যেতে হয়েছে তাকে। তাই জাতীয় পার্টি ও নিজের ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে যেমন আসন সমঝোতা করতে হয়েছে, তেমনি কেউ যেন ২০১৪ সালের মতো বিনা ভোটে এমপি হয়ে আসতে না পারে, নির্বাচনের মাঠে যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতার পরিবেশ থাকে সেজন্য নিজ দলের আগ্রহীদের তিনি স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করার অনুমতি দিয়েছেন। বলতে গেলে একটা ঝুঁকিই নিয়েছিলেন তিনি। দলের প্রার্থীর সঙ্গে দলীয় স্বতন্ত্রদের লড়াই বিভিন্ন আসনে সংঘাত সৃষ্টি করেছে, সহিংসতা হয়েছে, একে অন্যের বিরুদ্ধে কদর্য ভাষা প্রয়োগ করে বিষোদগার করেছে। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত হয়েছে, এই প্রার্থীরা তাদের সাধ্যমতো ভোটার নিয়ে আসতে সচেষ্ট ছিলেন নির্বাচনের দিনটিতে।

নির্বাচন হয়ে গেছে। এখন দেখার পালা শাসক দলের এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত কতটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রাখে নিজেদের ভেতর। জেলায় জেলায়, জনপদে জনপদে একই দলের নেতারা এখন নির্বাচনকেন্দ্রিক বিরোধিতা, কোন্দল আর হিংসাকে পাশ কাটিয়ে পারবেন কি আবার দলীয় কার্যালয়ে একসঙ্গে বসতে? একই সঙ্গে দলীয় কর্মসূচিতে যেতে? তবে বিপুলসংখ্যক দলীয় স্বতন্ত্রের বিজয়, মন্ত্রী-এমপিদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা একটা ধারণা পেলেন, কোন নেতার কোন অঞ্চলে কতটা জনভিত্তি আছে। ধারণা পেলেন, এমপি-মন্ত্রীদের প্রতি দলের নেতা, কর্মী এবং সমর্থকদের মধ্যে এত ক্ষোভ কেন?

নির্বাচন-পরবর্তী ১৪ দলের শরিক দলগুলো নিয়েও বড় ভাবনার জায়গা তৈরি হয়েছে। নৌকা নিয়েও জাসদের হাসানুল হক ইনু, জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশার পরাজয় বুঝিয়ে দিয়েছে তারা বড় নেতা হয়েও জনগণের মাঝে কোনো প্রভাব তৈরি করতে পারেননি। নৌকায় চড়ে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে থেকে ব্যক্তিগত সুবিধা নিয়ে নিয়ে নিজেদের দলকে বিলীন করে দিয়েছেন?

জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিয়েছিল ২৬টি আসন। কিন্তু তারা জিতেছে মাত্র ১১টি আসনে। খোদ ঢাকা-১৮ আসনের পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদের হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ থেকে সমঝোতা করে আসন না নিলে একটিতেও জয়ী হতে পারত কিনা এমন সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আগামীতে জাতীয় পার্টির রংপুরকেন্দ্রিক একটা আঞ্চলিক দল হিসেবেও তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারাটাই একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএম কোনো আবেদনই সৃষ্টি করতে পারেনি নির্বাচনে। দলের চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী এবং মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার দুজনেই জামানত হারিয়েছেন। এতে বোঝা গেল হঠাৎ করে এসে কোনো আনুকূল্য পেয়ে রাজনীতিতে সফল হওয়া যায় না। এটা তাদের বোঝা উচিত ছিল তখনই যখন আসন ভাগাভাগিতেও তাদের কিছু দেয়নি আওয়ামী লীগ। ব্যর্থতায় শেষ হলো তাদের নির্বাচনি মিশন।

প্রশ্ন হলো বিএনপি কী করবে? বছরের পর বছর আন্দোলন করে, বিদেশি দেশ ও সংস্থার কাছে ধরনা দিয়ে, নানারকম সহিংস কর্মসূচি দিয়েও নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি দলটি। এখন বলছে, নির্বাচন বাতিল করতে হবে। সেটিও আসলে অর্জিত হবে না। তাই এখন প্রশ্ন হলো দলটি আসলে কোন রাজনীতি করবে এখন। দীর্ঘ সময় ধরে সহিংস আন্দোলন করে যাওয়া সহজ হবে না। সরকার গঠনের পর এসবের দিকে আরও বড় নজর পড়বে সরকারের।

দলটি বলছে, নির্বাচনের পরও আন্দোলন অব্যাহত রাখা হবে। সেটা রাখাই যায়। এক বছর ধরে চলা আন্দোলন সফল হয়নি। তাই নির্বাচনের পরও একইভাবে চললে বিশেষ কিছু ফল হবে বলে মনে হয় না। নির্বাচনের আগে যা হয়েছে, নির্বাচন-পরবর্তী আন্দোলনের কর্মসূচিও মুখ থুবড়ে পড়বে বলেই বোঝা যাচ্ছে। সরকার নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী শক্ত হাতে দেশ পরিচালনা শুরু করলে কর্মসূচি সব হারিয়ে যাবে। বিএনপির আন্দোলন ডালপালা ছড়িয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারবে, সেই পরিস্থিতি দৃশ্যমান নয়।

বিএনপিকে তাই শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনই করে যেতে হবে। দলের দিক থেকে আগামী সরকারের জন্য আন্দোলনের আগাম চ্যালেঞ্জ সেই অর্থে কোনো চ্যালেঞ্জই নয়। তবে শাসক দলের কাছেও প্রত্যাশা যেন তারাও সহনশীল হয়। জেল থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হলে সেটা করে একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে রাষ্ট্রকার্য পরিচালনা করাই উত্তম কাজ। প্রতিশোধ স্পৃহা যেন বড় হয়ে দেখা না দেয়।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • বুধবার (সকাল ৮:৩৩)
  • ১লা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ২২শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • ১৮ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com