বর্তমান রাজনীতিতে আইনজ্ঞদের অবস্থান

ব্রিটিশ শাসকরা মূলত নিজেদের স্বার্থেই ভারত উপমহাদেশে রাজনৈতিক দল সৃষ্টি বা তৈরি করে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এর আগে উপমহাদেশ পরিচালনায় রাজনৈতিক দলীয় বা রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার অস্তিত্ব ছিল না। ব্রিটিশরা আমাদের শাসন-শোষণ করেছে সত্য, পাশাপাশি তারা আমাদের রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থায় রাজনীতিও চালু করিয়েছিলেন। সে সময়ের নেতৃস্থানীয়, গ্রহণযোগ্য, বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। কারণ তারা জানতেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন যে, সময়ের প্রয়োজনে রাজনৈতিক দল সৃষ্টি হবেই। আর তা ভারতীয়রা তাদের অধিকার সচেতন হয়ে, স্বাধিকার আন্দোলনের নিমিত্তে সৃষ্টি করলে, ব্রিটিশদের সামগ্রিক অনুকূলের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে তাদের ভারত শাসন, পরবর্তীকালে তাদের বিদায়, চলে যাওয়া ও ভারত ভাগ তথা (পাকিস্তান ও ভারতের) স্বাধীনতা পর্ব সংঘাতময় হতে পারত।

উপমহাদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস ব্রিটিশ শাসক তথা ইংরেজদেরই সৃষ্টি। যদিও মহাত্মা গান্ধীর মতো বিখ্যাত মানবতাবাদী নেতাও সেই কংগ্রেসেরই দু-দুবার সভাপতি ছিলেন। ব্রিটিশ সৃষ্ট অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস আর ভারতের বর্তমান কংগ্রেস মোটেই এক নয়। ভারতের রাজনীতিতেও ব্রিটিশ শাসনের পরিসমাপ্তির পর ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়।

পরবর্তীকালে ভারতের রাজনীতি, স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশ শাসন ও পরিচালনায় নেতাজি সুভাষ বসু, ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাস, জওহরলাল নেহেরু, পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ প্রায় সবাই ছিলেন আইনজ্ঞ, আইনবিদ বা আইনজীবী। সে হিসেবে ভারতসহ বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশের রাজনীতিতেই স্বাভাবিক কারণেই আইনজীবীদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি। এখনো ব্রিটেনসহ ইউরোপিয়ান গণতান্ত্রিক দেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উভয় আইন প্রণয়নকারী সংস্থা তথা সংসদের অধিকাংশ সদস্যই আইনজ্ঞ বা আইনজীবী।
সে হিসেবে আমেরিকার বর্তমান সিনেটের একশ সদস্যের ৬৬ জনই আইনজীবী বা আইনজ্ঞ। ৪৩৫ জন হাউস সদস্যের ২৪৯ জনই আইন পেশাসংশ্লিষ্ট।

বাংলাদেশের ভাষা, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ পরিকল্পনা ও পরিচালনায় নেতৃত্ব দানসহ স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশের সংবিধান রচনা, পরিচালনা ও দেশের রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে দেশের আইনজ্ঞ রাজনীতিবিদরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।

বিগত দিনের ’৬৬-এর ছয় দফা, ’৬৯-এর গণআন্দোলন, ’৭০-এর নির্বাচন ও নিকট-অতীতের ৯০ দশকের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সামরিক, স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িক শক্তিবিরোধী আন্দোলনেও আইনজীবী সম্প্রদায় নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান রাজনীতিতে দেশে আইনজীবীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ীসহ অন্যান্য সুবিধাবাদী গোত্রের অংশগ্রহণ।

বর্তমান সরকারে বেশ কজন আইনজীবী বা আইন অঙ্গনের মন্ত্রী ও সাংসদ থাকলেও দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে তেমন কেউ নেই। দেশের বৃহত্তম দুদল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একই অবস্থা।

আমাদের দেশের বর্তমান সংসদে আইনজীবী ১৩ শতাংশ, চিকিৎসক ও শিক্ষক ৮ শতাংশ, কৃষিতে জড়িত ৪ শতাংশ এবং অন্য পেশায় জড়িত ৭ শতাংশ। হলফনামায় রাজনীতিই যারা পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন, এই সংসদে আছেন মাত্র ৭ শতাংশ। ৯০-এর দশক থেকে সংসদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্যের মধ্যে ব্যবসায়ীর হার ছিল ৪৮ শতাংশ; ২০০১ সালে ৫১ শতাংশ ও ২০০৮ সালে ৬৩ শতাংশ। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৭৭ সংসদ সদস্য কোনো না কোনো ব্যবসায় সম্পৃক্ত ছিলেন বলে তাদের হলফনামায় উল্লেখ করেছিলেন, যা মোট সংসদ সদস্যের ৫৯ শতাংশ।

এক সময় সুপ্রিমকোর্ট বারকে দেশের দ্বিতীয় সংসদ বলা হতো। সব দলের বড় বড নেতা বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনায় বারে এসে আইনজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন, আইনজীবীরাও সিদ্ধান্ত দিতেন। জেলা আইনজীবী সমিতির নেতারা বা সিনিয়র আইনজীবীরা বিভিন্ন দলের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকতেন। আর এখন তার পুরোই উল্টো। সুপ্রিমকোর্ট বারসহ দেশের জেলা বারগুলোর নির্বাচনেও নমিনেশনগুলো আসে বারের বাইরের লোকদের থেকে। আইনজীবীরাই বিভিন্ন বিষয়ে ছুটে যান নেতাদের দ্বারে দ্বারে।

দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহীদ ও দুলাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত পবিত্র স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন থেকে ভারত হয়ে দেশে আসেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২।

দেশে কার্যকর প্রশাসন ছিল না, কর্মচারীর অপ্রতুলতা, রাস্তাঘাট ভাঙা, শূন্য অর্থনীতি, খালি ব্যাংক নিয়ে কাজ শুরু করলেন। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির জাতীয় নেতারা সংবিধান নিয়ে কাজ অনেক আগেই শুরু করেছিলেন। শাসন, আইন ও বিচার এই তিনটি বিভাগ নিয়ে ৪ নভেম্বর ১৯৭২ সংবিধান রেটিফাই করা হলো। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে সংবিধান কার্যকর করে বঙ্গবন্ধু ১৮ ডিসেম্বরই সুপ্রিমকোর্টে চলে আসেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় করতে। তিনি জানতেন ও বুঝতেন সুপ্রিমকোর্ট হলো সংবিধানের রক্ষক। তিনি সুপ্রিমকোর্টসহ আদালতে ক্রমান্বয়ে বাংলা চালু করার কথাও বলেছেন। বাংলায় রায় লেখার কথা বলেছেন। ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও ভারসাম্যের কথা বলে দেশ-জাতি গঠনে সবার কাছ থেকে কার্যকরী সাহায্য ও সহযোগিতা পাওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। জনগণের অধিকার, আইনের শাসন ও জনগণের সার্বিক অধিকার রক্ষায় সুপ্রিমকোর্ট ও দেশের আইনজীবী, বিচারক, এতদসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো বিকল্প ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন। সুপ্রিমকোর্টই সারাদেশের আইনজীবী আদালত সবই নিয়ন্ত্রণ করে।

আর তিনিই প্রথম বক্তৃতায় আইনের শাসন, সংবিধানের সুরক্ষা, জনগণের অধিকারের পাশাপাশি ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ ও আন্দোলন-সংগ্রামে আইনজীবীদের ভূমিকার কথা বললেন। শহীদদের নাম আদালতে খোদাই করে লেখার কথা বললেন। দেশ পরিচালনায় সবার সহযোগিতা চাইলেন। তিনি আরও বলেছেন, স্বাধীন দেশ চালাতে স্বাধীন জাতির সঙ্গে স্বাধীন সুপ্রিমকোর্টও দরকার। সংবিধানের চার মূলনীতির কথা বললেন। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার অঙ্গীকার করলেন। বিধ্বস্ত অর্থনীতির ওপর আদালত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে সুপ্রিমকোর্টের বই, বিল্ডিংয়ের জন্য নগদ ডলারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সর্বোপরি তিনি বলেছেন, আপনারা আইন নিয়ে কাজ করেন এবং জানেন, আমার চেয়ে ভালো বোঝেন। আমাকে সাহায্য করেন। যাতে তাড়াতাড়ি সবকিছু ঠিক করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি বিশ্বে। বঙ্গবন্ধু নিজে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছিলেন এই সুপ্রিমকোর্ট ও আইনজীবীদের তা তার ওই বক্তৃতায় সহজেই অনুমান করা যায়।

তিনি শুধু বক্তৃতায় উল্লেখ করেই শেষ করেননি। তিনি সুপ্রিমকোর্ট বারসহ দেশের সব জেলা বারের নবীন-প্রবীণ ও উদ্যমী আইনজীবীদের দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করেন ও জাতীয় সংসদসহ বিভিন্ন নির্বাচনে নমিনেশনও দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর সেই প্রথম সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে তার সতীর্থ সাথী যোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে পাশে থাকা দূরে থাকা সব আইনজীবী বন্ধু, বিচারক শুভাকাক্সক্ষীদের থেকে সাহায্যের হাত ধরতে এসেছিলেন। নতুন দেশ, নতুন নেতৃত্ব ও নতুন সংবিধান আর মানচিত্র। অর্থহীন কৃষি পরিকল্পনাহীন অপরিপক্ব নতুন আইনকানুন নিয়ে নতুন প্রশাসন নিয়ে দেশ পরিচালনায় সবার মতামত ও সক্রিয় সহযোগিতা নিতে এসেঁছিলেন এই সুপ্রিমকোর্ট বার ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে।

ওয়াহিদুজ্জামান স্বপন : বাংলাদেশি আমেরিকান আইনজীবী

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

আজকের দিন-তারিখ
  • বুধবার (রাত ৩:৫৪)
  • ১লা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ২২শে শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি
  • ১৮ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com